রাগবির আনন্দে বাংলার মেয়েরা

রাগবি বাংলাদেশে প্রায় অপ্রচলিত খেলাই। সেই রাগবি নিয়েই স্বপ্ন দেখছেন বাংলাদেশের মেয়েরা। ৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর সুলতানা কামাল মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সে হয়ে গেল তৃতীয় জাতীয় মহিলা রাগবি প্রতিযোগিতা। রাগবি ঘিরে মেয়েদের উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মতো।

রংপুরের কিশোরী রুনা আক্তার। মেয়েদের অনূর্ধ্ব-১৫ ফুটবলে খেলেছেন জাতীয় দলের হয়ে। ঢাকায় ২০১৭ সালের সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দলেও ছিলেন। খেলেছেন হংকংয়ের আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে। সেই রুনাই এখন ফুটবল ছেড়ে নতুন খেলা রাগবিতে মেতেছেন।

এমন গল্প শুধু রুনার একার নয়। ৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর সুলতানা কামাল মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সে গিয়ে রুনার মতো অনেককে পাওয়া গেল। যাঁরা প্রত্যেকে নিজের প্রতিভার প্রমাণ দিয়েছেন ফুটবল, কাবাডি ও হ্যান্ডবলে। এই মেয়েরাই এখন রাগবি খেলছেন।

রাগবিতেই স্বপ্ন দেখছেন এই েময়েরা
রাগবিতেই স্বপ্ন দেখছেন এই েময়েরা

রাগবি দলে নতুন স্বপ্ন দেখা খেলোয়াড়দের মধ্যে রংপুরের মৌরাসি আক্তার, বেলী আক্তার এখনো ফুটবল খেলেই সংসার চালান। ঠাকুরগাঁওয়ের শাহনাজ পারভীন, রুবিয়া আক্তার ফুটবলের পাশাপাশি কাবাডি খেলেন। আন্তস্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ১০০ মিটারে সোনা জিতেছেন রংপুরের নুরুফা নূরজাহান। ফুটবলার ইশরাত জাহানের দ্বিতীয় পছন্দ হ্যান্ডবল। ভলিবল ও কাবাডি খেলেন মরিয়ম নেসা। সবাই এসেছিলেন তৃতীয় জাতীয় মহিলা রাগবি প্রতিযোগিতায় খেলতে।

দেশে মেয়েদের রাগবির শুরু
বাংলাদেশ রাগবি ফেডারেশন ২০১৪ সালে প্রথম জাতীয় মহিলা রাগবি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। তখন ৭২ জন খেলোয়াড় নিয়ে হয়েছিল জাতীয় প্রতিযোগিতা। সেই সংখ্যাটা এবার ছাড়িয়ে গেছে ২৫০–এর ওপরে। বড় কথা এবারের আসরে অংশ নেওয়া ১৩টি জেলার সব মেয়েই নিজ নিজ জেলার। অথচ খেলোয়াড় কম থাকায় এর আগের আসরগুলোতে এক জেলার মেয়েরা খেলত অন্য জেলার হয়ে।
গত বছরের অক্টোবরে ভারতের ভুবনেশ্বরে এশিয়ান সেভেন এ সাইড রাগবি টুর্নামেন্টের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অভিষেক হয় বাংলাদেশের মেয়েদের। ওই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ মোটেও ভালো করেনি। হেরেছে গ্রুপ পর্বেই। কিন্তু এশিয়ার অন্যান্য দেশের খেলোয়াড়, কর্মকর্তাদের সামনে রাগবি নিয়ে দেখিয়েছে তাদের উন্মাদনা। খেলায় হারলেও হৃদয় জয় করে তবেই ফিরেছে।

রাগবিই ওদের ধ্যানজ্ঞান
ফুটবল শুরু করার দিনগুলো মনে পড়লে এখনো ভীষণ কষ্ট লাগে রুনার। বাড়ি থেকে লুকিয়ে অনুশীলনে যেতে হতো। এলাকার ছেলেরা তাদের দিকে তাকিয়ে বলত, ‘মেয়ে হয়ে জন্মেছিস, ফুটবল খেলতে হবে কেন?’ কিন্তু কোনো বাধা ওদের আটকে রাখতে পারেনি।
ফুটবলার হিসেবে ইদানীং নাম ছড়ালেও স্কুলের শিক্ষকেরা নতুন খেলার ধারণা দিয়েছেন মাত্র দুই সপ্তাহ আগে। কোচ এস এম ফেরদৌস আলম শিখিয়েছেন কীভাবে পয়েন্ট পেতে হয়। বল নিয়ে ছুটতে হবে সামনে। পেছনে পাস দেওয়া যাবে না। এখন রুনার চোখে শুধু রাগবির স্বপ্ন, ‘আমরা রাগবি খুব উপভোগ করছি। আমাদের পরিবার থেকে কোনো বাধা দেয় না কেউ। বাংলাদেশের মেয়েরা যদি ফুটবল খেলে বিশ্ব জয় করতে পারে, তাহলে রাগবিতে কেন পারবে না? আমরা একদিন রাগবি বিশ্বকাপে খেলতে চাই।’ সত্যি বলতে কি, অন্য সবার মনের কথাটা যেন অকপটে বলে দিলেন রুনা।

হাড্ডাহাড্ডি ফাইনাল
জাতীয় রাগবির ফাইনালটা ছিল উত্তেজনায় ভরা। নিয়মিত রাগবি না খেললেও শুধু স্ট্যামিনা আর ফিটনেসে এগিয়ে থাকার সুবাদে রংপুর ও ঠাকুরগাঁও ওঠে ফাইনালে। নির্ধারিত ৩০ মিনিটের খেলা শেষ হলেও কোনো দল নামের পাশে পয়েন্ট যোগ করতে পারছিল না। নিয়ম অনুসারে অতিরিক্ত ৪ মিনিট খেলার পরও পয়েন্টের দেখা নেই। এরপর শুরু হয় টাইব্রেকার। সেখানেও একই অবস্থা। ৩টি ড্রপকিক শেষে রংপুর ও ঠাকুরগাঁওয়ের পয়েন্ট ১-১। এরপর সাডেনডেথে রুপিয়া আক্তারের কিকটি গোলপোস্টের ওপর দিয়ে যেতেই উল্লাসে মেতে ওঠে ঠাকুরগাঁওয়ের মেয়েরা। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আনন্দে মাঠের ঘাসের ওপর শুয়ে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে। আসলে মেয়েদের জাতীয় রাগবির ফাইনালে ওঠা দুই দলের খেলা দেখে মনে হচ্ছিল, পয়েন্ট জেতা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিনতম কাজ!

চ্যাম্পিয়নস ট্রফি হাতে ঠাকুরগাঁওয়ের মেয়েরা
চ্যাম্পিয়নস ট্রফি হাতে ঠাকুরগাঁওয়ের মেয়েরা

নতুন সম্ভাবনা
প্রতিযোগিতা শেষে বাছাই করা দল নিয়ে শিগগিরই অনুশীলন ক্যাম্প শুরু করতে চায় রাগবি ফেডারেশন। এ বছর এপ্রিলে মেয়েদের এশিয়ান ফিফটিন এ সাইড রাগবি টুর্নামেন্ট, আগস্টে এশিয়ান রাগবি চ্যাম্পিয়নশিপ ও সেপ্টেম্বরে অনূর্ধ্ব-২০ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি টুর্নামেন্ট ঘিরে এখন থেকেই যত পরিকল্পনা কর্মকর্তাদের।
রাগবি অ্যাসোসিয়েশনের একমাত্র লেভেল ‘টু’ কোর্স শেষ করা কোচ মাহফিজুল ইসলাম এই মেয়েদের নিয়ে দারুণ আশাবাদী, ‘দুই বছর আগে এশিয়ার ৩১ দেশের মধ্যে আমরা ছিলাম ২৯তম। গত বছর ১১তম হয়েছি। এবার সপ্তম হয়েছি। মেয়েদের মধ্যে রাগবির আগ্রহ দিন দিন বেড়েই চলেছে। এটাই আমাদের জন্য সবচেয়ে আনন্দের খবর।’

বিশ্বকাপের স্বপ্ন
বাংলাদেশ রাগবি ফেডারেশন বর্তমানে এশিয়ান রাগবি ফেডারেশনের সহযোগী সদস্য। খুব দ্রুত পূর্ণ সদস্যপদ পাওয়ার আশা করছে বাংলাদেশ। পূর্ণ সদস্য হলেই বাংলাদেশের সামনে সুযোগ আসবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে খেলার। এশীয় পর্যায় থেকে বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে খেলার সুযোগও আসবে ধীরে ধীরে।
বাস্তবতা বলছে, সেই সময়টা অনেক দূরে। কিন্তু তাই বলে থেমে নেই রাগবির পথচলা। ঢাকার সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজ নিয়মিত মেয়েদের রাগবি চর্চা করছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, আনসারও মেয়েদের রাগবি দল গড়ার প্রক্রিয়াধীন। জাতীয় চ্যাম্পিয়ন ঠাকুরগাঁওয়ের অধিনায়ক শাহনাজ পারভীন শিমুর চোখ এখন স্বপ্নের বাতিঘরে, ‘ক্রিকেট, ফুটবলের মতো একদিন আমরাও বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে চাই। সেই স্বপ্ন নিয়েই মেতে আছি রাগবিতে।’