তখন মায়ের মুখটা মনে পড়ছিল

বিধ্বস্ত উড়োজাহাজ থেকে এভাবেই যাত্রীদের উদ্ধারে অভিযান চলছিল। ছবি: এএফপি
বিধ্বস্ত উড়োজাহাজ থেকে এভাবেই যাত্রীদের উদ্ধারে অভিযান চলছিল। ছবি: এএফপি
ইউএস–বাংলার উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার এক বছর পূর্ণ হচ্ছে ১২ মার্চ। নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দরে সেই দুর্ঘটনায় নিহত হন পাইলট, ক্রু, যাত্রীসহ ৫১ জন। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান ২০ জন, যাঁদের ৯ জন বাংলাদেশি। সেই বেঁচে ফেরাদের দলেই ছিলেন শাহরীন আহমেদশেখ রাশেদ রুবায়েত। দুঃসহ দুর্ঘটনার অভিজ্ঞতা শোনালেন তাঁরা দুজন।
শাহরীন আহমেদ
শাহরীন আহমেদ

নেপাল ভ্রমণের আগের কিছু ঘটনা এখন খুব মনে পড়ে। পদে পদে একেকটা করে বাধা আসছিল। দুর্ঘটনা না ঘটলে এসব হয়তো ভাবনাতেই আসত না। আরও বেশি মনে পড়ে বোর্ডিং পাসের পর নেপালের মেডিকেল শিক্ষার্থীদের দলটার দেখা পাওয়া। তাদের অনেকেই আর মায়ের কাছে ফিরতে পারেনি। আমরা একসঙ্গে উড়োজাহাজে উঠেছিলাম।
উড়োজাহাজটা ছেঁচড়ে গেল
যাত্রার আগের কিছু ঘটনার জন্য সিটে বসেও অস্থিরতা পেয়ে বসেছিল। পুরোটা পথে মুখ ফুটে কোনো কথা বলতে পারিনি। এভাবেই প্রায় দুই ঘণ্টা পেরিয়ে যায়। একসময় বুঝতে পারলাম, উড়োজাহাজ অবতরণ করবে। কিন্তু নামার মুহূর্তে আবার ওপরে উঠে গেল। কেন অবতরণ করতে পারল না, বুঝতে পরছিলাম না। দ্বিতীয়বার অবতরণের সময় জানালা দিয়ে রানওয়ে দেখা যাচ্ছিল। চেয়ে ছিলাম। দেখতে দেখতেই উড়োজাহাজটা বাড়ি খেল। ছেঁচড়ে গেল অনেকটা দূর। কান তালা লাগার মতো অসম্ভব আওয়াজ হলো। চোখ বন্ধ করে তখন শুধু সৃষ্টিকর্তাকে ডাকছিলাম।

আমার গায়ের ওপর ব্যাগ রাখার কম্পার্টমেন্ট ভেঙে পড়ল। পিঠটা বাঁকা হয়ে গেল। চোখ মেলে দেখি আমার সামনের একজনকে বের করে নেওয়া হচ্ছে। আমি বললাম, ‘আমাদের বাঁচান, আমাদের বাঁচান।’ এমন সময় একজন চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন, ‘আগুন, আগুন’। পরে বুঝেছি তিনি ছিলেন ইমরানা কবির।

আগুন লাগার ফলে উদ্ধারকারীরা আসতে পারলেন না। তখন ভীষণ অসহায়ত্ব ভর করল। মায়ের মুখটা খুব করে মনে পড়তে থাকল। মায়ের কাছে আমার হয়তো আর ফেরা হবে না। নিজে নিজেই সাহস সঞ্চয় করলাম। বেঁচে ফেরার তীব্র সাহস। আমাকে বাঁচতেই হবে।

বাঁ দিক হয়ে আমি পড়ে আছি। আমার পাশের ভদ্রলোক মাঝখানে পড়ে আছেন। মাথা ফেটে রক্ত ঝরছে। কষ্টেসৃষ্টে হাত এগিয়ে তাঁর হৃৎস্পন্দন বোঝার চেষ্টা করলাম। দেখলাম সাড়া নেই। নিথর পড়ে আছেন।

ইমরানা পেছন থেকে তখনো চিৎকার করে চলছেন, ‘আগুন, আগুন’। বুঝতে পারলাম, সে আগুনে পুড়ে কাতরাচ্ছে।
অগ্নিমুহূর্ত

একসময় আমার কাছেও আগুন চলে এল। ধীরে ধীরে আমার শরীরের অংশ পুড়তে থাকল। মাথার চুলে আগুন লাগল। হাত দিয়ে সে আগুন নেভালাম। আমার কাপড় পুড়ছে। পিঠ পুড়ছে। চেষ্টা করছিলাম মাথাটা ঠিক রাখার। তাই কষ্ট করে একটু সরিয়ে নিই।

একটা সময় আগুন নেভানো হলো। উদ্ধারকারীরা কাছাকাছি চলে এল। প্রাণভরে নিশ্বাস নিলাম। আমি সিটবেল্টে বাঁধা। দ্বিতীয় চেষ্টায় আমি নিজেই বেল্ট খুললাম। হ্যাঁচকা টানে উদ্ধারকারীরা আমাকে ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করল। তারকাঁটা ছিল সম্ভবত, ব্যথা পেলাম। ততক্ষণে দুর্ঘটনার প্রায় ২৫ মিনিট পেরিয়ে গেছে।

উদ্ধার করে ইমরানা আর আমাকে একই অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতালে নেওয়া হলো। সে ব্যথায় কাতর। তার হাত ভেঙেছে। শরীর পুড়েছে। আমারও পা ফুলে ঢোল হয়ে গেছে। জরুরি বিভাগে গিয়ে হুইলচেয়ারে বসতে হলো। ডাক্তার এসে বলল, ‘তোমার পা ভেঙেছে।’ শরীর কতটুকু পুড়েছে চিকিৎসক তা দেখল। আমি পানি খেতে চাইলাম। পুড়ে যাওয়া মানুষকে মূলত পানি খাওয়ায় না। আমাকে অল্প একটু পানি খেতে দিল।

তখন আমার মনে পড়ল বাড়িতে খবর দেওয়া জরুরি। ব্যাগটি আমার অক্ষত ছিল। উদ্ধারকারীদের কাছ থেকে আমি চেয়ে নিয়েছি। মোবাইলটা সেখানে ছিল। ফোন দিলাম। বাসার সবাই উদ্বিগ্ন ছিল, কথা শুনে কিছুটা স্বস্থি ফিরে পেল।

এমন সময় চিকিৎসক বলল, বার্ন ইউনিটে নিতে। সেখানে ড্রেসিং করল। কাপড় পরিবর্তন করা হলো। আমি স্বাভাবিক তখনো। আমি একটু আগেই যে বেঁচে ফেরা একজন মানুষ, তখন সে বোধও কাজ করছিল না।

বার্ন ইউনিটে আরও কয়েকজনকে আনা হলো। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন সবাই। রাত হলো। সাড়ে আটটা বাজে। বাড়িতে কল করলাম। সেই প্রথম শুরু হলো কান্না। সারা রাত কান্না করলাম।

অনেক মানুষ মারা গেছে তখন পর্যন্ত জানি না। ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছি যাদের দেখেছি, তারা আর বেঁচে নেই। একজন পরিচিত ডাক্তারকে জোরাজুরি করতেই বলল হতাহতের কথা। ইমরানার কথাও জানলাম, সে আইসিইউতে আছে।

১৬ মার্চ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকায় ফিরে এলাম। ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা চলল। তখন শুধু মনে হচ্ছিল, আমার স্বাভাবিক জীবনটা কেন এমন হলো। অসহনীয় কষ্টের দিনগুলো কাটতে থাকল।

দিনে দিনে সুস্থ হলাম। দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে হলো। পোড়া ক্ষত, ভাঙা পা একসময় সেরে গেল। কিন্তু মনের ভেতর জেঁকে বসল উড়োজাহাজের অবতরণের সময়ের ভীতি। এখনো উড়োজাহাজ ভ্রমণের সময় অবতরণমুহূর্তটা খুব ভয়ে ভয়ে কাটে। এ ভয় হয়তো সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে।

লেখক: শিক্ষক