আমাদের দিন পাল্টে যাবে, আর কান্না কইরেন না

আব্বা,
কেমন আছেন? আজ দুই মাস আপনাকে আমি দেখি না। বলতে পারছি না, আপনার জন্য আমার বুকের গহীনটায় কেমন পুড়ছে। আচ্ছা, যখন কাবিননামায় সই করছিলাম, সত্যিই কি আপনি আমাকে দূরে সরিয়ে দিতে চাচ্ছিলেন? খুব জানতে ইচ্ছে করছে এখন।
আব্বা, আজ আপনাকে বেশি মনে পড়ছে। মনে পড়ছে পড়ালেখা রেখে ক্রিকেট খেলার জন্যে বকা দিতেন, আদর করে ‘সুমু’ বলে ডাকতেন। বেতন হলে আমাকে নিয়ে মাসের বাজার করার জন্য মুদির দোকানে যেতেন। আব্বা, আপনার সঙ্গে বাজারে যেতে ইচ্ছে করছে খুব। তখন ছোট ছিলাম, তাই আপনাকে অনেক কিছুই বলতে পারিনি, কিন্তু আজ বলব।
মিন্টু কাকা যখন ঈদে আমাদের সবাইকে কাপড় দিত, তখন আপনি চুপ হয়ে থাকতেন। সবাইকে কাপড় না দিতে পারার অক্ষমতাই আপনার এই চুপ থাকার কারণ। কাপড় পেয়ে যতটুকু খুশি হতাম, আপনার ওই মলিন মুখ দেখে ততখানিই কষ্ট পেতাম, যা কখনো বলিনি। এক ঈদে আপনার কাছে বায়না ধরেছিলাম, আমাকে এক জোড়া হিল জুতা কিনে দিতেই হবে। তখন মনে হয় প্রথম শ্রেণিতে পড়ি। ঈদের আগের দিন অনেক ঘোরাঘুরি করেও কারও কাছ থেকে টাকা ধার না পেয়ে দোকানেই বাকি চাইলেন। দোকানদার বাকি দিল না, লজ্জায় আপনার মুখ লাল হয়ে গিয়েছিল। অবশেষে এক কাকার কাছ থেকে ৪৫০ টাকা নিয়ে আমার জুতাজোড়া কিনে দিয়েছিলেন। সেদিন আমি আপনাকে বলতে পারিনি, আপনার লজ্জা পাওয়ার বিনিময়ে আমার এ জুতাজোড়া দরকার নেই।
স্কুলে পড়াকালীন বেতন দেওয়ার যেদিন শেষ দিন, সেদিন আপনি আমায় স্কুলে পাঠিয়ে বলতেন আপনি এসে বেতন দিয়ে যাবেন। কিন্তু বলতেন না যে আপনার কাছে টাকা নেই। আমি ভয়ে থাকতাম, যদি টাকা না জোগাড় করতে পারেন। অবশেষে ঠিকই এসে বেতন দিতেন আপনি। আমি সেদিন ঠিকই বুঝতাম, আপনার কাছে টাকা নেই বলে স্কুলে এসে বেতন দিতেন, কিন্তু কিছুই বলিনি।
আপনি কোনো স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ার কথা বললে আমি বলতাম, প্রাইভেট পড়তে আমার ভালো লাগে না। সেদিন আপনার কথা ভেবেই আমি প্রাইভেট পড়তাম না, যেন প্রাইভেট খরচের টাকাটা সংসারে ব্যয় করতে পারেন, যেন আপনার শরীরের ঘাম কম ঝরে।
স্নাতক প্রথম বর্ষ থেকেই চাকরি করতাম বলে আপনি বলতেন, ‘পড়ালেখা তো আসমানে উঠছে।’ আমি চাকরি করতাম, যেন আপনার খরচ কমে যায়, কিন্তু আপনাকে কোনো দিন বুঝতে দিইনি।
আব্বা, আপনি যখন আম্মার জন্যে কোনো শাড়ি কিনে দিয়ে বলতেন, ‘জীবনে তো কোনো কিছুই এনে দিতে পারিনি, এই শাড়িটাই নাও’, তখন আম্মার মুখের হাসিটাই ছিল অন্য সব দিনের থেকে আলাদা। সেদিন আপনাদের কাউকেই বলতে পারিনি, এমনি করে চোখের সামনে থাকবেন সারা জীবন।
আপনার চোখে প্রথম পানি দেখি, যেদিন আমি এইচএসসিতে জিপিএ–৫ পাওয়ার পরও বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিংয়ের জন্য আপনার হাতে টাকা নেই। সেদিন আমিও কেঁদেছিলাম, কিন্তু আপনাকে বলতে গিয়েও বলতে পারিনি, ‘আমাদের দিন পাল্টে যাবে, আর কান্না কইরেন না।’
অনেক কথা বলার ছিল, যা বলতে পারিনি। সবশেষে শুধু এতটুকুই বলতে চাই, ‘আব্বা, যেখানেই থাকেন, ভালো থাকেন।’