এখনো গা শিউরে ওঠে

আমি তখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। বয়স দশ পেরিয়ে এগারো ছুঁই ছুঁই। বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে এক মাদ্রাসায় পড়তাম। প্রতিদিন বাড়িতে আসা-যাওয়া করলেও নিয়ম অনুযায়ী রাতের বেলা ছাত্রাবাসেই থাকতে হতো। দিনের বেলা যেভাবেই হোক, রাতের বেলা দলবদ্ধভাবে খাবার খেতে যেতাম। ফেরার পথেও ঠিক দলবদ্ধ হয়ে ফিরতাম। তবে দুষ্টুমির ছলে মাঝেমধ্যে কেউ একজনকে একা ফেলে আসতাম। রীতিমতো ওই দিন ছিল আমার পালা। আমার অগোচরে বাকিরা সিদ্ধান্ত নিল, তারা সবাই মিলে আমাকে একা রেখে আসবে। তাদের পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আমাকে না ডেকেই তারা চলে যায়। খাবার খেয়ে আমি প্রস্তুত, ওরা ডাকবে। কিন্তু না। অনেক সময় পেরিয়ে গেলেও কারও সাড়াশব্দ না পেয়ে নিজেই তাদের খোঁজে রওনা হলাম। খুঁজলাম যেখানে ওদের থাকার কথা। পেলাম না। তখনই বুঝে গেলাম, আজ আমারই কপাল পুড়েছে! বাড়ি থেকে ছাত্রাবাসের দূরত্ব বেশি না। তবে বয়সে ছোট ছিলাম বলে একা একা যাতায়াতে আব্বু-আম্মুর কড়া নিষেধ ছিল। ভাবলাম, এই পরিস্থিতিতে বাড়ি গেলে রাতে আর মাদ্রাসায় ফেরা হবে না। অন্যদিকে রাতে ফিরতে না পারলে পরের দিন শিক্ষকের কড়া শাস্তি ভোগ করতে হবে। এই ভয়ে একা একা ছাত্রাবাসের দিকে হাঁটতে শুরু করি।

দূরত্ব বেশি না হলেও মাঝপথে বেশ কিছু জায়গাজুড়ে ঘন গাছপালা আর ছোট একটা কবরস্থান ছিল। বড়দের মুখ থেকে শুনতাম, এই জায়গায় নাকি জিন-ভূতের আড্ডাখানা। রাতের বেলা একাকী কেউ বের হলে তার ওপর যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কাই বেশি। কেউ একজন রাতের বেলা একা বের হওয়ার পর আর বাড়ি ফেরেনি। অনেকের লাশ পাওয়ার খবরও শুনেছি। ওই রাতে আমি একা। তাই কিছুদূর হাঁটার পর নিজের অনিচ্ছাতেই মনের মধ্যে এসব ভয়ংকর চিত্র ভেসে ওঠে। ফলে ভীষণ ভয় আর বিভিন্ন দুশ্চিন্তা শুরু হয়। আপনা–আপনি ভয় পেতে শুরু করি। ভয়টা এমন ছিল যে দূরের কোনো শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল কেউ যেন আমাকে ডাকছে। এমনকি পাতার শব্দকে মনে হচ্ছিল কেউ যেন আমার পিছু নিল। শরীর ঘামতে শুরু করে। একপর্যায়ে পুরো শরীর ঘামে ভিজে যায়। এভাবে কিছু সময় হাঁটার পর ছাত্রাবাসের লাইটের আলো আর কিছু সহপাঠীর দেখা মিলল। এমন সবুজসংকেত দেখে মনে হচ্ছিল এ যেন কোনো এক স্বর্গের সুখ খুঁজে পেলাম। তখনো ভয়ের ঘোর যেন কাটছেই না। পরে এদিক-ওদিক কোনো দিকেই তাকানোর সাহস হচ্ছিল না। তাই সোজা রুমে চলে আসি। ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়ি।

এত দিন পেরিয়ে গেলেও সেই রাতটির কথা মনে পড়তেই গা শিউরে ওঠে!

 হাবীব আজাদ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।