আমাদের শহীদ ছোট মামা

১৯৭১ সাল। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলছে। আমরা তখন ঢাকা থেকে পালিয়ে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে চলে গিয়েছি। কিন্তু নিজেদের বাড়িতে থাকতে পারিনি, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। রাজাকারের উৎপাত–অত্যাচারে অন্য গ্রামে আশ্রিত। একদিন ছোট মামা সিদ্দিকুর রহমান এলেন সে বাড়িতে। যুদ্ধে যাবেন। যাওয়ার আগে সবার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। নানুকে বললেন, ‘মা, কষ্ট করে বড় করেছ, ছেলে হিসেবে শেষ বয়সে তোমার আর বাবার দেখাশোনা করা আমার দায়িত্ব; কিন্তু দেশ আমাকে ডাক দিয়েছে, দেশকে মুক্ত করতে যে আমাকে যেতে হবে।’ খালাদের বললেন, ‘যুদ্ধ শেষে ফিরে না এলে কেঁদো না, আমার মতো অনেক ভাই এ দেশে পাবে।’ যাওয়ার সময় নিজের ভালো জামাকাপড়, সুন্দর বিছানার চাদর ধুয়ে, ইস্তিরি করে স্যুটকেসে গুছিয়ে রাখলেন। বললেন, ‘স্বাধীন দেশে এই কাপড় পরব, এই চাদরটা বিছানায় বিছিয়ে ঘুমাব।’

মামা ছিলেন জেলার নামকরা ফুটবল খেলোয়াড়, তুখোড় ছাত্রনেতা, সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সবার প্রিয়। ১৯৭১ সালে বাজিতপুর কলেজ ছাত্র সংসদের সহসভাপতি (ভিপি)। বিভিন্ন সভা–সমাবেশে তাঁর প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর শোনা যেত একাত্তরের উত্তাল সময়ে। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর এলাকার ছাত্র জনতাকে সংগঠিত করতে লাগলেন, প্রশিক্ষণের জন্য পাঠালেন। এ ছাড়া যেসব মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে আশ্রয় নিচ্ছিলেন, তাঁদের সর্বাত্মক সহযোগিতায় অগ্রণী ভূমিকা নিলেন। তখন সব সময় বলতেন, ‘স্বাধীন হলে দেশটা আমাদের হবে।’

সেদিন বিদায় নিয়ে কিছুদূর গিয়ে আবার ফিরে এলেন মামা, পকেট থেকে ছোট চিরুনিটা বের করে আমার বড় বোনের হাতে দিয়ে বললেন, ‘রেখে দাও তোমার কাছে, দেশ স্বাধীন না হলে চুল আঁচড়াব না।’ ভারতে প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময় নানুকে একটা চিঠি লিখেছিলেন মামা। সেখানে লিখেছিলেন, ‘মা, মন খারাপ করো না। দোয়া করো দেশকে যেন মুক্ত করতে পারি।’

তখন অক্টোবর মাস। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে তাঁদের সহযোদ্ধা ভৈরবের আশু মারাত্মক আহত হলেন। মানবিক গুণাবলির অধিকারী সিদ্দিক আরেক সহযোদ্ধা যুদ্ধাহত আশুকে নিয়ে নননপুর গ্রামে আশ্রয় নিলেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আশ্রয়দাতা ছিল রাজাকার, সে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে অস্ত্রসহ তাদের তুলে দিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলে থাকার সময় তাঁর ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন করা হলো, মাথার চুল কেটে গাড়ির পেছনে বেঁধে রাস্তায় ঘোরানো হলো। অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করেও নতি স্বীকার করলেন না মামা। স্বাধীনতার পর যাঁদের জেল থেকে মুক্ত করা হয়েছিল, তাঁদের কাছ থেকে আমরা এই তথ্যগুলো জেনেছিলাম।

দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর, রমজানের ঈদের পরদিন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রেলওয়ে সেতুর ওপর আরও অনেকের সঙ্গে মামাকে ব্রাশফায়ার করে ফেলে দেয় পাকিস্তানি বাহিনী। সেই ২২ বা ২৩ জনের মধ্যে একজন বেঁচে ফেরেন। তিনিই আমাদের এ ঘটনা জানান।

স্বাধীনতার পর শোকাতুর আমার নানু কোনো দিন ঠিকমতো খেতে পারেননি, ঘুমাতে পারেননি। আমার নানা ছেলের শোকে ছিলেন মুহ্যমান। পাগলের মতো ঘুরে বেড়াতেন৷ কেউ যদি তাঁর কুশল জিজ্ঞেস করতেন, তিনি উত্তরে বলতেন, ‘কী আর আছে, সবই গেছে, অন্তিমে কি দেখতে পাব সুখের রবি উঠছে পুবে ফুটি?’

যে দেশ তাঁর দেহে–মনে মিশে ছিল, সেই দেশের মেঘনা, পদ্মা, ধলেশ্বরীর স্রোতে ভেসে কোথায় কোন মাটিতে তাঁর দেহ মিশে গেছে, আর খুঁজে পাইনি আমরা তাঁর স্বজনেরা। যুদ্ধ শেষ হয়েছে, দেশ আমাদের হয়েছে। আমাদের সবাইকে একটা স্বাধীন দেশ দিয়ে আমাদের ছোট মামা সিদ্দিকুর রহমান হারিয়ে গেছেন। গত ৪৭ বছরে এই দেশের অর্জন অনেক, তারপরও এই দেশের সাধারণ মানুষ সুখে, স্বচ্ছন্দে, শান্তিতে থাকতে পারলে আমাদের ছোট মামা এবং আরও যাঁরা প্রাণপ্রিয় দেশের জন্য নিজেদের উৎসর্গ করে গেছেন, তাঁদের আত্মা শান্তি পাবে।

তাহমীনা বেগম
অধ্যাপক ও শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ