শ্বাস নিন প্রাণভরে

বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ মো. রাশিদুল হাসান। ছবি: আশরাফুল আলম
বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ মো. রাশিদুল হাসান। ছবি: আশরাফুল আলম

২০০১ সাল। নড়াইলের শেখ রুহুল আমিনের বয়স চল্লিশের কোঠায়। হঠাৎ অদ্ভুত সব উপসর্গ দেখা দিল শরীরে। ঠান্ডা পানিতে গোসল করলে, সামান্য ধুলোবালিতে কিংবা ভিড়ভাট্টায় গেলে কাশতে কাশতে দম যেন বন্ধ হয়ে যায়। রুহুল আমিনের জীবনটা একপর্যায়ে বাসা–অফিস আর চিকিৎসকের চেম্বারের গণ্ডিতে আটকে গেল। তবু প্রাণভরে নিশ্বাস নিতে পারলেন না।

ভিন্ন ধরনের চিকিৎসা

শেখ রুহুল আমিনের মতো মানুষেরা কি প্রাণভরে শ্বাস নিতে পারবেন? বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ মো. রাশিদুল হাসান বলছেন, পারবেন। তাঁর কথা হলো অসুখ–বিসুখ থাকবে, ওষুধ–পত্তরও চলবে। কিন্তু নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলে চলবে না। সামান্য কিছু ব্যায়াম আর জীবনাচরণের পরিবর্তন জীবনে ইতিবাচক ভূমিকা আনতে পারে। কিন্তু কীভাবে? এমন প্রশ্নের জন্য তিনি ২০ এপ্রিল ছোটখাটো একটা মহড়া দেখার সুযোগ করে দিলেন তাঁর প্রতিষ্ঠান ঢাকার ইনজেনিয়াস পালমো–ফিটে।

অধ্যাপক মো. রাশিদুল দেশের শীর্ষস্থানীয় বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ। ছিলেন জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক। উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে যখন পড়েন, তখন মাকে হারিয়েছেন। ছেলের হাত ধরে মা বলেছিলেন, ‘তুই ডাক্তার হোস বাবা।’ রোগী দেখার সময় এখনো মৃত্যুপথযাত্রী মায়ের মুখটা চোখে ভাসে বললেন।

বক্ষব্যাধি প্রসঙ্গে আসা যাক। মো. রাশিদুল হাসান বললেন, তাঁরা যখন ছাত্র ছিলেন, তখন বক্ষব্যাধি বলতে মূলত বোঝানো হতো যক্ষ্মা রোগকে। পড়ালেখাও ছিল যক্ষ্মাকেন্দ্রিক। এখন শুধু যক্ষ্মা নয়, শিক্ষার্থীরা অ্যাজমা, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি), ব্রঙ্কিয়াকটেসিসসহ আরও নানা বিষয়ে পড়ছেন। বাংলাদেশে প্রতি পাঁচজনে একজনের সিওপিডি আছে। তবে রোগ যা–ই হোক, আর তার চিকিৎসা যেমনই হোক, সবটাই ফুসফুসের রোগ। মানুষ এসব রোগে ভুগতে ভুগতে নিজেকে স্বাভাবিক জীবন থেকে গুটিয়ে নেয়। বেশির ভাগ সময় ঘরে কাটায়। কাজকর্ম করতে পারে না। এমনকি খেতেও পারে না। কাশির দমকে খাবার খাদ্যনালিতে না গিয়ে শ্বাসনালিতে চলে গিয়ে মৃত্যুঝুঁকি তৈরি হয়।

বসে থাকতে থাকতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন রোগী। একসময় তাঁর হাত–পায়ের পেশিও দুর্বল হয়ে পড়ে। এই মানুষদের জন্যই তিনি এখন ‘ফুসফুসের পুনর্বাসন’ বিষয়ে নজর দিচ্ছেন। এককথায় বলতে রোগীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনাই তাঁর লক্ষ্য। রোগীরা ইনেজনিয়াস পালমো ফিটে তাঁদের রোগ, ঝুঁকি ও ঝুঁকি প্রশমনের উপায় জানেন, ব্যায়াম শেখেন এবং খাদ্য ও পুষ্টি সম্পর্কে জানতে পারেন।

রুহুল আমিন এখন

এই প্রতিবেদনের শুরুতে যাঁর কথা বলা হচ্ছিল, সেই শেখ রুহুল আমিনের (৬৪) সঙ্গে দেখা এই পুনর্বাসন কর্মসূচিতেই। ইনজেনিয়াস পালমো ফিটের চিকিৎসক ও কর্মীদের সহযোগিতায় তিনি দেখালেন কীভাবে চলছে তাঁর প্রাণভরে শ্বাস নেওয়ার চিকিৎসা। প্রথমে তাঁকে দীর্ঘ সময় ধরে ফুঁ দিতে দেখা গেল। তারপর মুখে ধরা হলো সরু নলের মতো একটা জিনিস। জানা গেল, নলের ভেতর আছে তিনটি বল। ফুঁ দিয়ে নলটি তিনি ফোলাতে পারছেন কি না, পারলেও তিনটি বলই সম–উচ্চতায় ওঠাতে পারছেন কি না, সেটাই দেখা হচ্ছে। না পারলেও ক্ষতি নেই। পরেরবার তিনি নিশ্চয়ই পারবেন এমন কথা বলে আশ্বস্ত করা হচ্ছে। এই ব্যায়ামের একটা ডাক্তারি নামও আছে—থ্রি বল স্পাইরোমিটার।

এর ফাঁকে আরও একজনকে দেখা গেল। এসেই চড়লেন সাইকেলে। প্রথমে ধীরে প্যাডেল ঘোরালেন, তারপর বাড়ালেন লয়। জানা গেল, হাত আর পায়ের মাংসপেশি দুর্বল হয়ে গেছে। জোর ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। প্রথম প্রথম পারতেন না মোটেও, এখন পারছেন। আরও কয়েকজনকে অপেক্ষা করতে দেখা গেল। তাঁরা পরের ব্যাচে দলবদ্ধ ব্যায়াম ও ক্লাসে অংশ নেবেন। যে ঘরে ব্যায়াম করানো হচ্ছে, সেখানেই অক্সিজেন নেওয়ার যন্ত্র চোখে পড়ল একটা।

সেবাগ্রহীতাদের এভাবেই ব্যায়াম করানো হয়।
সেবাগ্রহীতাদের এভাবেই ব্যায়াম করানো হয়।

অধ্যাপক রাশিদুল হাসান বলছিলেন, অক্সিজেন নিয়েও এই ব্যায়াম করা যায়। সেবাগ্রহীতার তালিকায় আছেন ৯ বছর থেকে ৯০ বছর বয়সী মানুষ। একজন রোগী আছেন, যাঁর ফুসফুসে ক্যানসার আছে। অস্ত্রোপচার ও কেমোথেরাপির পর এখন তিনিও আসছেন ব্যায়াম করতে। একজন রোগীর কথা বলতে গিয়ে চিকিৎসক আবেগাপ্লুত হয়ে গেলেন। তিনি অক্সিজেন নিয়েও ১০ মিটার হাঁটতে পারতেন না, এখন টানা ৩০০ মিটার হাঁটতে পারেন। সাইকেল চালান। একটা চাকরিও করছেন।

রোগীরা ঠিক কতটা সন্তুষ্ট? নাম না প্রকাশ করার শর্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলছিলেন, তিনি ভালো আছেন। ১৬ দিনের কোর্সে মোট ৩২টি ব্যায়াম শিখেছেন। ব্যায়ামটা শিখে নিলে ঘরেও করা যায়। ব্যায়াম করে দম পাচ্ছেন, ঝরঝরে বোধ করছেন, কাজের গতিও বেড়েছে আগের চেয়ে।

ফুসফুসের ব্যায়াম

অধ্যাপক মো. রাশিদুল হাসান বলছিলেন, ফুসফুসের এই পুনর্বাসনের কাজটা ইউরোপে হয়ে আসছে বহু বছর ধরে। ইউরোপের দেশগুলোয় জেনারেল প্র্যাকটিশনাররাই এই কাজটা করে থাকেন। বাংলাদেশের খুলনা ও রংপুরে দুজন চিকিৎসক এমন কেন্দ্র করেছেন। ওই কেন্দ্র দুটি দেখেই তিনি ঢাকার কেন্দ্রের পরিকল্পনা করেন। ২০১৭ সাল থেকে প্রস্তুতি নেন। চিকিৎসক ও অন্য সহকারীরা প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের পর গত বছরের শুরুর দিকে চালু করেন এই কেন্দ্র। তিনি মনে করেন, এমন আরও কেন্দ্রের দরকার বাংলাদেশে। রোগীদের অনেকেই বলেছেন, ব্যায়াম করতে এসে তাঁদের সময়টা বেশ ভালো কাটে। ঘরে বসে থেকে বিষণ্নতায় ভুগতে শুরু করেছিলেন। এখানে এসে গল্পগুজবের সুযোগ পান। ভবিষ্যতে যাঁরা এমন রোগে ভুগছেন, তাঁদের নিয়ে ক্লাব করার ইচ্ছে তাঁর। এতে করে কর্মসূচি শেষেও তাঁদের যোগাযোগটা অক্ষুণ্ন থাকবে।

যাঁরা বক্ষব্যাধিতে ভুগছেন, তাঁরা চাইলে এই সেবাটা নিতে পারেন। সপ্তাহে দুই দিন দুই ঘণ্টা করে ষোলো দিন কোর্স করতে খরচা পড়বে ১০ হাজার ৫০০ টাকা। দুই মাস পর ফলোআপ। অধ্যাপক মো. রাশিদুল হাসানকে এই সেন্টারে সহযোগিতা করছেন চিকিৎসক রওশন আরা খানম, মো. আরমান ফয়সাল ও ফাতেমা ইয়াসমিন। তাঁদের সঙ্গে রোগীদের ব্যায়ামে সহযোগিতা করেন একঝাঁক প্রশিক্ষক। ‘জোশ এবং হুঁশ’—দুটিকে কাজে লাগিয়ে রোগীদের স্বস্তি দেওয়াই তাঁদের কাজ বলে জানালেন অধ্যাপক রাশিদুল হাসান।

যোগাযোগ
অধ্যাপক ডা. রাশিদুল হাসান, বাড়ি নম্বর ৪১, শ্যামলি রিং রোড, ঢাকা।  মুঠোফোন: ০১৭০১৬৭৭৭৭৭