বলাকা এক্সপ্রেস

অলংকরণ : মাসুক হেলাল
অলংকরণ : মাসুক হেলাল

ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় ফিরব। কিন্তু সময়মতো স্টেশনে পৌঁছেও তিস্তা এক্সপ্রেসের কোনো সিট পেলাম না। তবে টিকিট একটা মিলল বলাকা এক্সপ্রেসের। একটু দেরিতে পৌঁছাবে, তবে সিট পাওয়ায় মেনে নিলাম।

কিছুক্ষণের মধ্যে সব আসন ভরে গেল। এক বৃদ্ধা উঠলেন। বয়স আশির কম বলে মনে হলো না। আমার সামনের সিটে বসেছেন। সাদা কাপড় পরা, গলায় পুঁতির মালা। কোথায় নামবেন? জিজ্ঞাসা করায় বললেন, ‘কালীবাড়ি স্টেশনে।’

কালীবাড়ি স্টেশন নামে বর্তমানে কোনো স্টেশন নেই বলে জানালেন এক যাত্রী। আরেকজন বললেন, বর্তমান ফাতেমা নগরই আগের কালীবাড়ি স্টেশন। এরশাদ সরকারের সময় কিছু জায়গার নামের সংস্কার হয়েছিল। তখন কালীবাড়ি হয়েছিল ফাতেমা নগর (ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলায় এর অবস্থান)।

বৃদ্ধার সঙ্গে কেউ নেই। একটা ছোট বস্তায় তাঁর জিনিসপত্র। একটি লাঠিতে ভর করে নিজে নিজেই চলাফেরা করেন। তিনজন সন্তান, তবে তাঁরা তাঁর সঙ্গে নেই। স্বামীর ভিটাতেই তিনি থাকেন। অল্প সময়ের ব্যবধানে ট্রেন ফাতেমা নগর থামল। স্বভাবসুলভ বৃদ্ধাকে নামানোর জন্য গেটে নিয়ে গেলাম। প্ল্যাটফর্ম ট্রেন থেকে অনেক নিচু হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধার জন্য নামা কঠিন ছিল। বৃদ্ধা এমনিতেই স্বাস্থ্যহীন ছিলেন। একপর্যায়ে কোলে করে নামিয়ে দিলাম। নামাতে গিয়ে খেয়াল হলো, গায়ে এ মাঘ মাসের শীতেও (তখন জানুয়ারি মাস) কোনো মোটা কাপড় নেই।

যখন তাঁকে স্টেশনে রেখে সিটে ফিরতে যাব তখন জিজ্ঞাসা করলাম, যেতে পারবেন তো একা একা? বৃদ্ধা বললেন, অন্ধকারে পথ চিনে যেতে পারব না। রাতটুকু স্টেশনে কাটিয়ে দেব। সকালে বাড়ি যাব। ততক্ষণে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। মহিলার অসহায়ত্বের কথা ভাবলাম অনেকক্ষণ। এই শীতের রাতে শীতবস্ত্র ছাড়া তাঁকে খোলা স্টেশনে কাটাতে হবে রাত। মনটা খারাপ হয়ে গেল।

ফিরে এলাম আমার সিটে। পাশের যাত্রী তখন ঝিমোচ্ছে। মাঝেমধ্যে গায়ের ওপর পড়ার মতো অবস্থা। একটা বিরক্তিকর পরিস্থিতি। ট্রেন তখন আবার থেমেছে। মনে হলো গফরগাঁও স্টেশন, পরে জানা গেল গফরগাঁও এখনো আসেনি। আউলিয়া নগর এটি। আমার আব্বা-আম্মার সঙ্গে ছোটবেলায় মুতালিব চাচার বাড়িতে বেড়িয়েছি। ছোটবেলার স্মৃতিতে যখন ডুবে আছি, তখন আমাদের সামনে একটি বস্তা নিয়ে আরেক বৃদ্ধা এসে ট্রেনের মেঝেতে বসে গেলেন। বস্তা এত পুরোনো যে তা কালচে, তেল চিটচিটে হয়ে গেছে। দুই পাশের সিটের মধ্যে বসে থাকতে থাকতে তিনিও ঘুমিয়ে পড়লেন। চেয়ে দেখছিলাম, জীবনকে তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করেন। সামান্য পেলেই খুশি, একটু বসতে পারলেই ঘুম।

ট্রেন রাত ১১টায় কমলাপুর স্টেশনে পৌঁছাল। সবাই নেমে গেছে ট্রেন থেকে। আমিও নামার জন্য দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। এবার দেখি বৃদ্ধা তাঁর শাড়ির একটি অংশ দিয়ে মুখ ঢেকে ঘুমিয়ে আছেন। সবাই নেমে গেল, তিনি নামলেন না। আমি ভাবতে লাগলাম, ফাতেমা নগরের বৃদ্ধা সকাল হলেই তাঁর বাড়িতে যেতে পারবেন, তাঁর একটা ঠিকানা আছে, এই মহিলার যে তা–ও নেই। বলাকা এক্সপ্রেসেই ঘুমিয়ে থাকতে থাকতে ঘুমের মধ্যেই হয়তো আবার আউলিয়া নগর পৌঁছাবে ট্রেনটি। কোথায় যাবেন? কেন যাবেন? তাঁর মনের কাছে এর জবাব না পেয়ে হয়তো আরও কয়েকটা দিনরাত কাটিয়ে দেবেন বলাকা এক্সপ্রেসে।

লেখক: অধ্যাপক, উর্দু বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়