স্কুটি হাঁকিয়ে ৬৪ জেলা

>
মানসী সাহা (বাঁয়ে) ও সাকিয়া হক। ছবি: নীরব চৌধুরী।
মানসী সাহা (বাঁয়ে) ও সাকিয়া হক। ছবি: নীরব চৌধুরী।
স্কুটি হাঁকিয়ে তাঁরা বেরিয়েছিলেন দেশ ভ্রমণে। সাকিয়া হক ও মানসী সাহা—এই দুই চিকিৎসক বন্ধু জেলায় জেলায় যেমন ঘুরেছেন দর্শনীয় স্থান, তেমনি সচেতনতার বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন স্কুলছাত্রীদের কাছেও। তাঁদের এই ভ্রমণের নাম ‘নারীর চোখে বাংলাদেশ’। ৫ মে এ উদ্যোগের সমাপন হবে ঢাকায়। তবে দুই বন্ধু ৬৪ জেলা ঘোরার মাইলফলক ছুঁয়েছেন আগেই। এই ভ্রমণ-অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন সাকিয়া হক
পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্টে সাকিয়া–মানসীসহ অন্য ভ্রমণকন্যারা।
পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্টে সাকিয়া–মানসীসহ অন্য ভ্রমণকন্যারা।

ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সন্ধানে
আমাদের উদ্দেশ্যই ছিল নিজের দেশ দেখা, সেই সঙ্গে স্কুলের মেয়েদের সচেতন করা। তবে আরেকটি অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল, সেটা হলো মোটরবাইকে যে নারীরাও দেশ ভ্রমণ করতে পারেন, এটা প্রতিষ্ঠিত করা। তাই আমরা যে জেলাতেই গিয়েছি, সে জেলার দর্শনীয় স্থান, ইতিহাস ও ঐতিহ্যসমৃদ্ধ স্থান ঘুরে বেড়িয়েছি, নতুনভাবে জেনেছি। প্রতিটি জেলা কোনো না কোনো কারণে আলাদাভাবে মনে থাকবে। এর মধ্যেও শেরপুর, সুনামগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল আর রাঙামাটির কথা আলাদাভাবে বলতে হয়। এই জায়গাগুলো আমার সবচেয়ে ভালো লাগার। শ্রীমঙ্গলে যখন পা রেখেছিলাম, তখন গোধূলিবেলা। বৃষ্টি হচ্ছিল। অনেকটা মেহেদিপাতার মতো চা–পাতার কাঁচা গন্ধ নাকে এসে লাগছিল। শ্রীমঙ্গল নাম শুনলেই সেই সুগন্ধ এখনো টের পাই। আর রাঙামাটি ভালো লাগার কারণ কাপ্তাই হ্রদ আর উঁচু–নিচু পাহাড়ি রাস্তা।

স্কুলপড়ুয়া মেয়েদের কাছে স্বপ্ন বিলানোর মতবিনিময়।
স্কুলপড়ুয়া মেয়েদের কাছে স্বপ্ন বিলানোর মতবিনিময়।

তিতলি, ক্যামেলিয়া এবং দুর্ভোগের রাত
ভোলার চরফ্যাশন থেকে লক্ষ্মীপুর যাত্রাটা জীবনের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতাগুলোর একটি। তখন ঘূর্ণিঝড় তিতলির প্রভাবে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিল। স্কুলের কাজ শেষে, দুপুরের খাওয়ার পর শরীরজুড়ে যখন আলসেমি জেঁকে বসেছিল, তখন তাগাদা পেলাম ফেরি ধরার। রাস্তায় নামতেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টি কিছুটা কমতেই আমরা আবার বাইকে উঠি। চিন্তা-ভয়-ঘূর্ণিঝড়—সব তুচ্ছ করে আমরা যখন ইলিশ ফেরিঘাটে পৌঁছালাম, তখনই দেখি ফেরিটা ঘাট থেকে ছেড়ে যাচ্ছে। কয়েক মিনিটের জন্য ফেরিটা হাতছাড়া। উত্তাল নদীর তীরে চায়ের দোকানে পরবর্তী ফেরির জন্য অপেক্ষা ছাড়া করার কিছুই ছিল না।

দুই ঘণ্টা পর পরবর্তী ফেরি ক্যামেলিয়া এল। সাড়ে আটটার দিকে ফেরি ছাড়ল। পুরো ফেরিতে নারী বলতে আমরা চারজন। আমাদের সঙ্গে এযাত্রায় ছিলেন আরও দুজন। নদী এতটাই উত্তাল যে সমুদ্রের মতো মনে হচ্ছিল। শেষমেশ আমরা যখন লক্ষ্মীপুর পৌঁছলাম, তখন রাত ১১টা। কাদাপানি বিধ্বস্ত ফেরিঘাটের রাস্তা পেরিয়ে যখন প্রধান সড়কে উঠলাম, তখন সত্যিকার অর্থেই কোথাও কেউ নেই।

কক্সবাজার জেলাকে বিদায় জানানোর মুহূর্তে। ছবি: সংগৃহীত
কক্সবাজার জেলাকে বিদায় জানানোর মুহূর্তে। ছবি: সংগৃহীত

বেডি মাইনসে গাড়ি চালায়!
আমাদের যাত্রায় পথে পথে কটুবাক্য শুনতে হয়েছে, তবে বেশি শুনেছি স্তুতিবাক্যই। একটি ঘটনা খুব মনে পড়ে। নড়াইল থেকে যশোর যাচ্ছিলাম। বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে স্কুটিতে ছুটছি আমরা। এমন আচমকা মুহূর্তে রাস্তার পাশে দাঁড়ানো একজন মধ্যবয়সী নারীর পাশ কাটাতেই বাতাসে ভেসে এল, ‘বেডি মাইনসে গাড়ি চালায়’! চালকের আসনে ছিলাম বলে তাঁর দিকে তাকানো হয়নি। কিন্তু তাঁর অবিশ্বাস্য মুখ–চোখের সামনে কল্পনা করতে পারছিলাম, নারীও যে মোটরবাইক চালাতে পারে, তিনি হয়তো নিজের চোখে কখনো দেখেননি।

কুড়িগ্রামের প্রথম আলো চরে
কুড়িগ্রামের প্রথম আলো চরে

চলতে চলতে প্রথম আলো চরে
কুড়িগ্রামে আমাদের অনুষ্ঠানটি ছিল সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে। সেই আয়োজনেই জানতে পারি প্রথম আলো চরের স্কুলটার কথা। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের স্কুলে আমরা গিয়েছি, কিন্তু প্রত্যন্ত চরের স্কুলে তখনো যাওয়া হয়নি। অন্য রকম অভিজ্ঞতার আঁচ পেয়ে চরের পথে রওনা দিলাম। কুড়িগ্রাম সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে এই চর। কিছুটা পথ মোটরবাইকে, কিছুটা নৌকায় যেতে হলো। গিয়েই একটু চমক লাগল উপস্থিতি দেখে, এত প্রত্যন্ত চরের একটা স্কুল তবু শিক্ষার্থীতে ভরা। জানতে পারলাম, শীতকাল বলে নাকি এখন উপস্থিতি একটু কম, বর্ষা মৌসুমে প্রায় ৪০টি চর থেকে নৌকায় ছেলেমেয়েরা আসে। এখন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এখানে শিশুরা পড়তে পারে। ফি দিতে হয় না, বই-খাতাও বিনা মূল্যে। আমাদের পেয়ে ওরাও ভীষণ খুশি হলো। কর্মশালার জন্য সবাইকে মাঠে আনা হলো। আমরা কথা বললাম নানা বিষয় নিয়ে। বাল্যবিবাহের বিষয়টি সেখানে আলাদাভাবে বলেছি। প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগটা খুব ভালো লেগেছে।

খাগড়াছড়ির পথে
খাগড়াছড়ির পথে

পথে পথে ‘পাংচার’
পুরো যাত্রায় কতবার চাকা পাংচারের কবলে পড়েছি, তা হয়তো হিসাব করে বের করা যাবে। কিন্তু যে ধকল পোহাতে হয়েছে, তা তো শব্দে ব্যাখ্যা করা দায়। যেমন বগুড়া থেকে নওগাঁ যাওয়ার ‘অতিরিক্ত’ মোলায়েম রাস্তায় মানসীর স্কুটির চাকা পাংচার হয়ে যায়। এমন চাকা পুরো নওগাঁ শহরে না পেয়ে বগুড়া থেকে আনার ব্যবস্থা করা হলো। পুরো একটি দিন থাকতে হলো নওগাঁয়। এমন অভিজ্ঞতা হয়েছিল পটুয়াখালী থেকে কুয়াকাটা যাওয়ার সময়। আমরা যখন পথের দুই পাশের সৌন্দর্যে বিমোহিত, তখনই হুট করে আমার স্কুটির চাকা পাংচার! পিচ গলা রোদের মধ্যে অনেকক্ষণ ছোটাছুটি করার পর জানতে পেলাম, সাত কিলোমিটার দূরের একটি বাজারে সারাইখানা আছে। নিরুপায় হয়ে স্কুটি অটোতে উঠিয়ে রওনা হই সেই বাজারের উদ্দেশে। সেই বাজারে গিয়ে সমাধান হলো না, কারণ এই চাকা সারানোর যন্ত্র নেই। তাই দুজনকে বরগুনা শহরে পাঠানো হলো নতুন চাকা আনার জন্য। নতুন চাকায় স্কুটি ছুটল চার ঘণ্টা পর।

জানতে হবে আত্মরক্ষার কৌশল
জানতে হবে আত্মরক্ষার কৌশল

উত্তরবঙ্গের মায়া
আমরা উত্তরবঙ্গে গিয়েছিলাম এ বছরের জানুয়ারি মাসে। একে শীতকাল, তার ওপর উত্তরবঙ্গ। একেবারে যেন সোনায় সোহাগা। প্রতিদিন ভোরে উঠে তিন পরত কাপড়ের ওপর আরও তিন পরত পরতাম। মোটরবাইকে দুজন ফোলা ফোলা মানুষ ওঠার পর দেখতাম ব্যাগ রাখার জায়গা নেই। ঠেসেঠুসে চলতাম পথে। হেলমেট, গ্লাভস, নাকটুপি, কানটুপি, জুতা-মোজার ভিড়ে শুধু চোখ দুটি দেখা যেত। টানা ২০ দিন আমরা ছিলাম বাংলাদেশের ম্যাপের উত্তর-পশ্চিম ভূখণ্ডে। সংস্কৃতিমনা ও অতিথিপরায়ণ এই মানুষগুলো দেখে অভিভূত হয়ে যেতাম। পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, পাবনা, নওগাঁ নামগুলো শুধু শব্দ নয়, মায়া হয়ে জড়িয়ে আছে।