রোজ যেখানে ১০ হাজার মানুষের ইফতার

প্রতিদিন কাতারে কাতারে বসে ইফতার করেন রোজাদারেরা। ছবি: ছুটির দিনে
প্রতিদিন কাতারে কাতারে বসে ইফতার করেন রোজাদারেরা। ছবি: ছুটির দিনে

প্রথম দেখাতেই মনে হলো, আয়োজনটা অন্য রকম। বিশাল মাঠে শামিয়ানা টাঙানো। তার নিচেই কাতারে কাতারে বসা মানুষ, যেন ‘তিল ঠাঁই আর নাহি রে’। কাতারে কাতারে বসা মানুষদের সামনে স্বেচ্ছাসেবকেরা পৌঁছে দিচ্ছেন ইফতারি। অধীর আগ্রহ নিয়ে তখন রোজাদারদের অপেক্ষা মাগরিবের আজানের।

এই অপেক্ষমাণ রোজাদারেরা এখানে আসতে শুরু করেন বিকেল সাড়ে পাঁচটার পর থেকে। ছয়টা বাজলে সেই আসাটা মিছিলের মতো দেখায়। দু-চার শ মানুষ নয়, কয়েক হাজার মানুষ এখানে জমায়েত হতে থাকে। মানুষের জন্য এই ইফতারের এ কাজ করে চলেছেন সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার নলতা কেন্দ্রীয় আহ্ছানিয়া মিশন। পবিত্র রমজানজুড়ে চলে ইফতারের এ আয়োজন। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এখানে ইফতারে শামিল হয়।

আমরা গিয়েছিলাম ২৪ মে সকালে। ঘড়ির কাঁটায় যখন বেলা ১১টা। নলতা আহ্ছানিয়া মিশন বিশ্রামাগার চত্বর এলাকায় তখন বিশাল কর্মযজ্ঞ। সকাল সকালই শুরু হয়েছে ইফতারি তৈরির আয়োজন। অর্ধশতাধিক মানুষ কাজ করছেন। তাঁদের কেউ ছোলা ভুনার কাজে সহায়তা করছেন, কেউবা ফিরনি রান্না করছেন, কেউ আবার শিঙাড়া, ডিম সেদ্ধ ও চিড়া ভেজানোর কাজে ব্যস্ত। অনেকে দল পাকিয়ে কলা ও খেজুর বাছাই করছেন। থালাবাসন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায়ও ব্যস্ত দেখা গেল এক দলকে। এই প্রস্তুতি চলল বেলা দুইটা পর্যন্ত। এরপরই শুরু হয় রোজাদারদের ইফতারের স্থান প্রস্তুত করার কাজ।

এর মধ্যেই কথা হয় প্রধান বাবুর্চি মহব্বত আলীর সঙ্গে। তিনি জানান, রোজার এক মাস প্রতিদিন ভোর থেকে তাঁরা কাজ শুরু করেন। ১৮-২০ মণ দুধের ফিরনি প্রস্তুত করা হয়। সেদ্ধ করা হয় ১০ হাজার ডিম। ইফতারের অন্যান্য অনুষঙ্গ প্রস্তুত করার বিষয়টি তো আছেই।

মহব্বত আলী এখানে আছেন ৩০ বছর ধরে। শুরু থেকেই তিনি এখানে ইফতারি প্রস্তুতের কাজ করছেন। খাবারের গোটা আয়োজনের দেখভাল করলেও তিনি মূলত ফিরনি ও ডিম সেদ্ধ করার কাজটি আলাদাভাবে তদারকি করেন। এ কাজে তাঁকে সহযোগিতা করেন ১৫ জন। ইফতারির অন্যান্য উপকরণ প্রস্তুত করার জন্য আছেন আরও প্রায় ৩৫ জন।

শামিয়ানার নিচে বসার জায়গা প্রস্তুত হলো। ততক্ষণে বেলা তিনটা বেজে গেছে। ইফতারি সরবরাহ ও বসার ব্যবস্থা করার জন্য স্বেচ্ছাসেবকেরা তখন প্রস্তুত। এই স্বেচ্ছাকর্মীর সংখ্যাও কম নয়, প্রায় ৭০০ জন। সবাই এসেছেন নিজ উদ্যোগে। বেলা তিনটার দিক থেকে শুরু হলো ইফতারি বণ্টনের কাজ। এই স্বেচ্ছাসেবকদেরই একজন আমিনুর রহমান। কাজের ফাঁকেই বলেন, ‘একজন রোজাদার ইফতার করতে এসে যাতে কোনো ধরনের সমস্যায় না পড়েন, আমরা সেই চেষ্টা করি। তাঁদের জুতা রাখার ব্যবস্থাও করি।’

ইফতারের সময় যাতে কোনো ধরনের অসুবিধা না হয়, তা তদারকি করেন মিশনের কার্যকরী পরিষদের সদস্যরা। মিশনের কার্যকরী পরিষদের সদস্য ইনামুল হক ও আবুল ফজল জানান, প্রতিদিন মিশনের মাঠে ও আশপাশের মসজিদে আট হাজার মানুষ ইফতার করে। দুই হাজার ইফতারি সাতক্ষীরা, খুলনা, যশোরসহ বিভিন্ন এলাকার প্রতিষ্ঠান, মসজিদ ও মিশন শাখায় পাঠানো হয়। মিশনে ইফতার করার জন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ আসে।

যখন প্রস্তুতি চলছিল ইফতারি বণ্টনের, আমরা হাজির হই নলতা কেন্দ্রীয় আহ্ছানিয়া মিশনের মুখ্য হিসাবরক্ষক এবাদুল হকের সামনে। তিনি জানান এই আয়োজনের আদ্যোপান্ত, ব্যয় বৃত্তান্ত। এই যেমন ইফতার মাহফিলের জন্য রোজার দেড় মাস আগে থেকে প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। প্রায় ১০ লাখ টাকা দিয়ে চলতি বছর অস্থায়ী শেড নির্মাণ করা হয়েছে, রোজাদারদের ঝড় ও বৃষ্টির মধ্যে কোনো অসুবিধা না হয়, এই কথা মাথায় রেখে। প্রতিদিন ১০ হাজার মানুষের জন্য ইফতারি প্রস্তুত করা হয়। ডিম, ছোলা, চিড়া, ফিরনি, কলা, খেজুর দিয়ে প্রতিদিন খরচ হয় ২ লাখ ৫৫ হাজার। তবে ডিম না দিলে ৭০-৮০ হাজার টাকা খরচ কম হয়।

নলতা কেন্দ্রীয় আহ্ছানিয়া মিশনের আহ্বায়ক সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাংসদ আ ফ ম রুহুল হক। তিনি শোনালেন এই উদ্যোগের ইতিহাস। ১৯৩৫ সালে খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লাহর নলতা কেন্দ্রীয় আহ্ছানিয়া মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে তিনি প্রতিবছরই রমজানে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করতেন। প্রথম অবস্থায় ৮-১০ জনকে তিনি ইফতারি খাওয়াতেন। পরে কলেবর বাড়তে থাকে। তাঁর মৃত্যুর পর মিশন কর্তৃপক্ষ এ আয়োজন অব্যাহত রেখেছে।