জীবনের গল্পে সম্মাননা

মোহাম্মদ রাকিবুল হাসান
মোহাম্মদ রাকিবুল হাসান

পেশাগত কাজেই কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে গিয়েছিলেন মোহাম্মদ রাকিবুল হাসান। সেই যাতায়াতের শুরু ২০০৭ সালে। তিনি আলোকচিত্রী। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম জুমা প্রেসের হয়ে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্ত পেশাজীবী হিসেবে কাজ করেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আরও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হয়ে।

ক্যামেরা কাঁধে ছুটে বেড়ান দেশ-বিদেশ। তুলে আনেন মানুষের গল্প। সেই গল্পের খোঁজেই পরিচয় হয়েছিল শিবিরের নারীদের সঙ্গে, যাঁরা ২০১৭ সালে নৃশংসতার শিকার হয়ে মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে এসেছেন।

তাঁদের জীবনের গল্প শোনেন, ছবি তোলেন। ২০১৮ সালের সেই সিরিজ ছবির নাম দেন ‘দ্য লোটেড অনার’ বা হারানো সম্ভ্রম। ছবিগুলো এবার দ্য হিউম্যান রাইটস প্রেস অ্যাওয়ার্ডস পুরস্কার বিজয়ী হলো। দ্য হিউম্যান রাইটস প্রেস অ্যাওয়ার্ডস হংকংভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা। এশিয়াজুড়ে মানবাধিকার-বিষয়ক প্রতিবেদনের জন্য প্রতিবছর সংস্থাটি সংবাদকর্মীদের পুরস্কৃত করে থাকে। সেই ধারাবাহিকতায় এবারের আয়োজনটি ছিল ২৩তম। এ আয়োজনের মূল উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান দ্য ফরেন করেসপনডেন্টস ক্লাব, হংকং, হংকং জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন, অ্যামনেস্টি ইটারন্যাশনাল। ১৬ মে পুরস্কারের ১৩টি বিভাগে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়। ফটো সিরিজ বিভাগে পুরস্কৃত হয়েছেন আলোকচিত্রী মোহাম্মদ রাকিবুল হাসান।

মোহাম্মদ রাকিবুল হাসানের পুরস্কারজয়ী সিরিজের ছবি
মোহাম্মদ রাকিবুল হাসানের পুরস্কারজয়ী সিরিজের ছবি

মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার নারীদের করুণ গল্প উঠে এসেছে সিরিজের ছবিগুলোতে। একেকটি বাস্তব গল্প মানুষের চিন্তার জগৎকে নাড়া দেয়। মানুষের প্রতি মানুষের নৃশংসতার উদাহরণ যেন ছবির মানুষগুলো। মোহাম্মদ রাকিবুল হাসান বলছিলেন, ‘ধর্ষণের শিকার একজন মানুষের ছবি তোলার বিষয়টি স্পর্শকাতর। সাংবাদিকতার নৈতিকতায় নির্যাতিত মানুষের নাম-পরিচয়-ছবি প্রকাশ করা হয় না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্ন। কারণ, অনেকেই হত্যাকাণ্ডের বিচার চান। তাই কেবল তাঁদেরই ছবি তুলেছি বা কথা বলেছি, যাঁরা নিজের ইচ্ছায় কথা বলতে রাজি হয়েছেন, ছবি তুলতে সম্মতি দিয়েছেন।’ তবু কাজটি ছিল কঠিন। ছবিতে উপস্থাপনের বিষয়টি যেমন ভাবিয়েছে, তেমনি সামনাসামনি অনেকের জীবনের গল্প শুনতে শুনতে মুষড়ে পড়েছেন রাকিবুল।

মোহাম্মদ রাকিবুল হাসানের পুরস্কারজয়ী সিরিজের ছবি
মোহাম্মদ রাকিবুল হাসানের পুরস্কারজয়ী সিরিজের ছবি

শেরপুর শহরে বেড়ে ওঠা রাকিবুল ক্যামেরা কাঁধে নিয়েছেন ২০০২ সালে। তখন তিনি অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পড়ুয়া। ক্লাসের অংশ হিসেবে সেই যে ক্যামেরা হাতে নিয়েছিলেন, তা-ই একসময় তাঁর পেশা হয়ে গেল। ২০০৬ সালে দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে পেশাগত আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ শুরু করেন। পাশাপাশি দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, নদীভাঙন, আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গাদের জীবন তাঁর ক্যামেরায় করুণ গল্প হয়ে উঠে আসে। সংঘাতপূর্ণ এলাকার ছবি তুলতে গিয়েছিলেন ফিলিপাইনে। সেখানে দুই জঙ্গিগোষ্ঠীর সংঘাতের ছবি তুলেছেন। এসব কাজের স্বীকৃতিও মিলেছে। বিভিন্ন সময় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছেন। যেমন ২০১৮ সালে পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সম্মানজনক লুসি অ্যাওয়ার্ড। রাকিবুল হাসান বলছিলেন, ‘পুরস্কার পেতে সত্যিই ভালো লাগে। কাজের প্রতি দায়িত্বটা পোক্ত হয়, আগ্রহ জন্মায়। মানবাধিকার নিয়ে কাজ করতে আমার ভালো লাগে। ছবি তুলে আমরা তো যুদ্ধবিগ্রহ বন্ধ করতে পারব না, কিন্তু মানুষের বিবেককে নাড়া দিতে পারব। তাতে হয়তো যুদ্ধবিগ্রহ প্রশমিত হবে।’