একটি করে রঙিন হাসি

নতুন পোশাক পাওয়ার আনন্দ। ছবি: এহসান-উদ-দৌল্লা
নতুন পোশাক পাওয়ার আনন্দ। ছবি: এহসান-উদ-দৌল্লা

এ মাসের শুরুতে বিরাট এক দ্বিধায় পড়েছিলেন শাহ সিকান্দার শাকির। খণ্ডকালীন চাকরির প্রস্তাব পেয়েছেন। তবে যোগ দিলে নিয়মিত টিউশনটা ছেড়ে দিতে হবে। সেই টিউশন ছেড়ে দিলে সম্মানী পাবেন না। সম্মানী না পেলে এবার ‘কাজটি’ করবেন কী করে! মনের ভেতর সংশয় যখন দানা বাঁধতে শুরু করেছে, তখনই শাকির নিয়োগকর্তার কাছে গেলেন। বললেন, ‘আমি চাকরিতে যোগ দিতে পারি, তবে এ মাসের বেতনটা মাস শেষের আগেই দিতে হবে।’

একে তো চাকরিই শুরু করেনি, তার ওপর বেতন নিয়ে কথা। গম্ভীর মুখে নিয়োগকর্তা কারণ জানতে চাইলেন। শাকির কাঁপা গলায় জানিয়ে দিলেন, বেতনের টাকায় তিনি অসহায় শিশুদের জন্য কাপড় কিনবেন। এ কাজটি তিনি কয়েক বছর ধরে করেন। নিজের হাতখরচের জমানো টাকা, কখনো টিউশন থেকে পাওয়া টাকায় এসব পোশাক কেনেন। নিয়োগকর্তা রাজি হলেন। অবশেষে ২৫ মে সেই টাকায় কেনা পোশাক বন্ধুদের সঙ্গে হাসিমুখে বিতরণ করেছেন শাকির। এই হাসির রেশ এখনো যেন তাঁর মুখে লেগে আছে, ‘যার পোশাক কেনার সাধ্য নেই, নতুন পোশাক পাওয়ার সম্ভাবনাও নেই। এমন একজন শিশুর হাতে রঙিন একটা জামা স্বপ্নের মতো। শিশুদের স্বপ্নপূরণের মতো আনন্দ আর কিছুতে কি আছে!’

শাকিরের কথা শুনে সে আনন্দ যেন আমাদের কিছুটা ছুঁয়ে গেল। তিনি সিলেটে প্রথম আলো বন্ধুসভার সভাপতি। সিলেটেরই মুরারী চাঁদ কলেজে (এমসি কলেজ) স্নাতকোত্তর পড়ছেন। অসহায় শিশুদের জন্য বন্ধুসভা ‘একটি করে রঙিন জামা’ নামের যে কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, তারই একজন কান্ডারি তিনি। আর এমন শাকিরেরাই সারা দেশে বাস্তবায়ন করছে কর্মসূচিটি। যেমন যশোরের কাজী তাহমিনা। সদ্য স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। উদ্যোক্তা হওয়ার বাসনা নিয়ে হস্তশিল্পের কাজ করছেন। তিনিও তিন বছর ধরে ঈদে নতুন পোশাক কেনেননি। নিজের ঈদের পোশাকের জন্য বরাদ্দের সবটুকু তিনি দিয়ে দেন অসহায় শিশুদের পোশাক কেনার জন্য। তবে তাহমিনার একটা বিশেষ শর্ত থাকে। তার টাকায় কেনা পোশাক যেন মেয়েশিশুরা পায়। তাহমিনা বলছিলেন, ‘মেয়েরা সব সময়ই তো অবহেলিত থাকে। পরিবার থেকে নতুন পোশাক পাওয়ার ক্ষেত্রেও তা লক্ষ করা যায়। তাই আমি আমার সাধ্যমতো ওদের জন্য দিই।’

প্রথম আলো বন্ধুসভার নতুন জামা পেয়ে যেন ওদের মুখে ঈদের আনন্দ খেলে গেল। ছবি: খালেদ সরকার
প্রথম আলো বন্ধুসভার নতুন জামা পেয়ে যেন ওদের মুখে ঈদের আনন্দ খেলে গেল। ছবি: খালেদ সরকার

একটি করে রঙিন জামা

বন্ধুসভার এই কর্মসূচির শুরুটা ২০১৭ সালে। জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের আয়োজন হলেও তা বাস্তবায়ন করেন সারা দেশেরা তরুণপ্রাণ বন্ধুরা, যারা (বিশেষত কমিটির সদস্য) প্রত্যেকেই নিজেদের সাধ্যমতো শামিল হন এ আয়োজনে। এ ছাড়া শুভাকাঙ্ক্ষীদের সহায়তাও নিয়ে থাকেন। এরপর দল বেঁধে কাপড় কেনা, তাই নিয়ে ছুটে যাওয়া নগরীর বস্তিতে, রেলওয়ে স্টেশনে, নিম্ন আয়ের মানুষের তল্লাটে। সেখানে গিয়েই তাঁরা হাসিমুখে বিতরণ করেন এসব নতুন পোশাক। জামালপুর বন্ধুসভার সিফাত আবদুল্লাহর সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তিনি তখন দলের সঙ্গে গেছেন পোশাক কিনতে। বাজেট বিবেচনায় পছন্দের পোশাক কিনছিলেন শহরের দোকান থেকে। বলছিলেন, ‘অর্থ সংগ্রহ, কাপড় কেনা, এরপর একজন শিশুর হাতে তুলে দেওয়া—কাজটি সহজ নয়। তবে নতুন পোশাক পেয়ে শিশুটা যখন নির্মল হাসি দেয়, তখন সে হাসি মনে হয় স্বর্গীয়। মনটা ভরে যায়।’

এবার ঈদুল ফিতরের আগে সারা দেশে বিভাগীয়, জেলা, উপজেলা ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ১২৮টি বন্ধুসভার বন্ধুরা নিজ উদ্যোগে অসহায় ও দুস্থ শিশুদের উপহার দেবেন নতুন জামা। ২ জুন পর্যন্ত চলবে এই কর্মসূচি। এবারের আয়োজনের মধ্যে ১৫ হাজার শিশুর হাতে তুলে দেওয়া হবে নতুন পোশাক। ২০১৮ সালে এ আয়োজনে প্রথম আলো বন্ধুসভা ১২ হাজার জামা উপহার দিয়েছিল। এর আগের বছর ১০ হাজার ২১৩ জন সুবিধাবঞ্চিত শিশুর হাতে তুলে দেওয়া হয় নতুন পোশাক।

রাজধানীতে কয়েক দফায় পোশাক বিতরণ করা হচ্ছে। এমন একটি পোশাক বিতরণের আয়োজন ছিল ২৮ মে, ঢাকার কড়াইল বস্তির শিশুদের জন্য সে উদ্যোগটি নিয়েছিল জাতীয় পর্ষদের সদস্য তাসনিম তুর্যী। বস্তির ১২৩ জন শিশুকে নতুন জামা দেওয়া হয়। যাদের কারোই এমন নিশ্চিত জীবন নয় যে ঈদে নতুন জামা পাবেই। একে তো তারা অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের, এর ওপর কারও বাবা নেই, কারও মা অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। তাই ঈদে নতুন পোশাক পাওয়া যেন তাদের জীবনে স্বপ্ন। সারা দেশে এমন স্বপ্নই পূরণ করে চলেছে বন্ধুসভার তরুণ সদস্যরা।