মৌসুমি উদ্যোগ

উৎসব সামনে রেখে আছে উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ
উৎসব সামনে রেখে আছে উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ

বছরঘুরে আসে নানা রকম ঋতু, উৎসব, পার্বণ। এই যেমন এখন বিশ্বকাপ নিয়ে মেতে আছে পুরো দেশ। একেকটি মৌসুমের চাহিদা বিবেচনা করেও কিন্তু আপনি উদ্যোক্তা হতে পারেন। কীভাবে?

যেমন এই সময়টির কথাই ধরুন। রাস্তার ভিড়ভাট্টায় বাংলাদেশের জার্সি পরনে অন্তত একজন মানুষ আপনার চোখে পড়বেই। ক্রিকেটপ্রেমী এ দেশের মানুষের গায়ে লাল-সবুজ টিশার্ট, হাতে লাল-সবুজের ব্রেসলেট, মোবাইলের কভার, আরও কত কী। এই সময়টাকে কাজে লাগিয়ে কিন্তু উদ্যোক্তা হতে পারেন। বিশ্বকাপ মাথায় রেখে বাজারে আনতে পারেন নতুন কোনো পণ্য। যদি সেই পণ্যটি চমকপ্রদ হয় এবং আপনি ঠিকঠাকভাবে ক্রেতার কাছে পৌঁছে যেতে পারেন, ক্রিকেটপ্রেমী মানুষ নিশ্চয়ই আপনার উদ্যোগের সঙ্গে থাকবে।

খেলাধুলার বাইরে এসে একটু ভিন্নভাবে ভাবি এবার। ধরুন কেউ একজন খুব ভালো রান্না করতে পারেন কিংবা সুন্দর গয়না তৈরি করেন। গ্রামে কিংবা শহরে যখন কোনো মেলার আয়োজন হয়, তখন এই প্রতিভা প্রকাশের একটি সুযোগও তৈরি হয়। হাতে বানানো মাটির জিনিস, গয়না, পিঠা, হাতের কাজের পোশাক থেকে শুরু করে পছন্দনীয় যেকোনো পণ্য নিয়ে মেলায় অংশগ্রহণ করা যায়। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছেলেমেয়েই পড়াশোনার ফাঁকে এ ধরনের সৃজনশীল কাজগুলো করে থাকেন।

কদিন আগেই গেল ঈদ। এ সময় মানসম্পন্ন আতর, জায়নামাজ, টুপি, তসবিসহ নানা পণ্য আপনি ক্রেতার কাছে পৌঁছে দিতে পারেন। উৎসবকেন্দ্রিক কিছু ব্যবসা এক দিনেরও হতে পারে। যেমন কেউ হয়তো খুব ভালো মেহেদি দিতে পারেন। ঈদের আগের রাতে কিংবা আগের দুই দিনের জন্য তিনি মেহেদি পরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিতে পারেন। এ ধরনের সৃজনশীল কাজে আয় হবে, আবার আনন্দও হবে।

ফাল্গুন বা বৈশাখের উৎসব হলো ফুলের ব্যবসার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। এ সময় বাজারে ফুলের চাহিদা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি থাকে। বড় পরিসরের আয়োজনের বাইরেও পয়লা বৈশাখ বা পয়লা ফাল্গুনের দিনে এলাকার অলিগলিতে এক দিনের জন্য ফুলের দোকান চোখে পড়ে। যদি নিজে দোকান দিতে না পারেন, আপনি হয়তো এসব দোকানে ফুল সরবরাহ করতে পারেন। ইদানীং বৈশাখ, ফাল্গুনে মেয়েরা মাথায় ফুলের টোপর পরতে শুরু করেছে। এমন কোনো নতুন ‘আইডিয়া’ও আপনি হাজির করতে পারেন, যা ক্রেতারা লুফে নেবে। বৈশাখে লাল-সাদা শাড়ি বা টিশার্ট বিক্রির জন্য ফেসবুকে একটা পেজ খুলে ফেলতে পারেন। শুরুতে নাহয় পরিচিতজনদের মধ্যেই বেচাকেনা হলো। ছোট উদ্যোগ থেকেই আপনি বড় কিছু করার সাহস পাবেন। চাইলে দোকানগুলোতে লাল-সাদা শাড়ি-টিশার্ট সরবরাহও করতে পারেন।

ষড়ঋতুর বাংলাদেশে গরমের সময় অস্থিরতার পাশাপাশি ব্যবসার ভালো সুযোগ তৈরি হয়। খুব অল্প বিনিয়োগ করে কয়েক বন্ধু মিলে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা নিজের এলাকাতে একটা ‘জুস কর্নার’ অথবা শরবতের দোকান দিয়ে ফেলা যায়। মানের দিকে একটু লক্ষ রাখলে নিশ্চয়ই আপনি ক্রেতাদের কাছ থেকে সাড়া পাবেন। তাই বলে জানুয়ারির তীব্র শীতে জুসের ব্যবসা করতে গেলে ভুল করবেন। এ সময় বরং বেছে নিতে পারেন হুডি বা জ্যাকেটের ব্যবসা। আজকাল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক ছাত্রছাত্রীই শীতের সময় নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয় বা বিভাগের নাম বা লোগো বসানো হুডি বিক্রি করছেন। লাভ-লোকসান যা-ই হোক, একটা অভিজ্ঞতা যে হচ্ছে, সেটাও নিশ্চয়ই ফেলনা নয়।

দিন দিন ব্যবসার ধারণায় খুব একটা পরিবর্তন না এলেও ধরনের পরিবর্তন চোখে পরার মতোই। অফলাইনের ব্যবসার সঙ্গে এখন অনলাইনের ব্যবসাও সমানতালে বাজার দখল করে চলছে। সমস্যা হলো আমাদের সংস্কৃতি এবং নিজেদের মধ্যে লালিত মানসিকতা। আমরা অনেক ছোট উদ্যোগকে প্রায়ই অসম্মানের চোখে দেখি। কিন্তু আমরা ভুলে যাই, ছোট কাজের অভিজ্ঞতা ছাড়া বড় কাজে সফল হওয়া সম্ভব না।

উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী শচীন দেব বর্মনের একটা গান আছে ‘তুমি আর নেই সে তুমি’। এই সেই তুমির গল্পটা আজকের চীনের সঙ্গে খুব মানানসই। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের দিনগুলোতে ১৯৬৬ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত চীনের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ রাখা হয়েছিল। এরপরও দীর্ঘ একটা সময় বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধই ছিল। এ সময়টা উদ্যোক্তা কিংবা উদ্ভাবনের জায়গায় চীনকে ঠিক কত দূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে, তার স্পষ্ট প্রমাণ অর্থনীতিতে তাদের আজকের অবস্থান। অনেক ডিগ্রি নিয়ে বেকারত্বের খাতায় নাম লেখানোর নাম শিক্ষা নয়, এই বোধটা বাংলাদেশের সব তরুণের মধ্যে জাগ্রত হওয়া এখন সময়ের দাবি। কোনো কাজকে ছোট করে না দেখে বরং উদ্যোগী মানসিকতা নিয়ে শুরু করার সাহস করলেই পরিবর্তন আসবে। আমেরিকা, লন্ডনের মতো জায়গায় অবসরে তরুণেরা তুষারপাতের পর তুষার পরিষ্কারের কাজ করেন। কাজকে যাঁরা ছোট করে না দেখে উদ্যোগ হিসেবে দেখেন, ভবিষ্যৎ তাঁদের জন্যই সুন্দর হয়।

রাশেদুর রহমান: নির্বাহী পরিচালক, ইনোভেশন, ক্রিয়েটিভিটি অ্যান্ড এন্ট্রাপ্রেনারশিপ সেন্টার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জুবেলী খানম: শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা

‘টার্গেট’ ঠিক করতে গিয়ে ভুল হয়ে যায়

কীভাবে মৌসুমভিত্তিক উদ্যোগ গ্রহণ করা যায়, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে সে সম্পর্কে বলেছেন ‘চাকরি খুঁজব না, চাকরি দেব’ সংগঠনের পরিচালক সাজ্জাত হোসেন।

মৌসুমভিত্তিক উদ্যোগের সম্ভাবনা

আমাদের দেশের জনসংখ্যা এবং সংস্কৃতি, দুটোই মৌসুমভিত্তিক উদ্যোগের জন্য খুব উপকারী। বছর ঘুরে বিভিন্ন উৎসব আসে, কিছু কিছু পণ্যের চাহিদা বাড়ে। ক্রেতাও অনেক। এই যেমন ঈদুল ফিতর শেষ হলো। এ সময় সেমাই, বাদাম, কিশমিশ থেকে শুরু করে পাঞ্জাবি, টুপি এসবের একটা চাহিদা তৈরি হয়েছিল। নির্ভেজাল ডটকম নামে আমাদের একটা ওয়েবসাইট আছে। আমরা যেমন এর মাধ্যমে ঈদের সময় সেমাই সরবরাহ করেছি, গ্রীষ্মকালের কথা মাথায় রেখে আম এনেছি। এসব থেকে ভালোই সাড়া পাওয়া গেছে। মৌসুমি উদ্যোগের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এর মাধ্যমে ব্যবসার অভিজ্ঞতা হয়। এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কেউ হয়তো ব্যবসায় নিয়মিত হতে পারেন।

মাধ্যম কী হতে পারে?

স্বল্পমেয়াদি এই উদ্যোগের জন্য ক্রেতার কাছে পৌঁছানোর মাধ্যম একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ফেসবুকের কল্যাণে এখন কাজটা অনেক সহজ হয়ে গেছে। চাইলে একটা নির্দিষ্ট গ্রুপকে টার্গেট করেও ব্যবসা করা যায়। অফলাইনে ব্যবসা করার একটা উপায় হলো, সরাসরি মাঠে নেমে যাওয়া। এ ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাকে সাহসী হতে হবে। যেমন ধরুন, ঠিক করলাম আমি ঈদের আগে পাঞ্জাবি বিক্রি করব। যেসব জায়গায় মানুষের ভিড় থাকে কিংবা অফিস থেকে মানুষ যে পথে ফেরে, সেখানে আমি পাঞ্জাবি হাতে দাঁড়িয়ে যেতে পারি। বিশ্বকাপের মৌসুমে জার্সি নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের সামনে যেতে পারি। এ ক্ষেত্রে একটা বড় বাধা হলো সংকোচ। সংকোচ কাটিয়ে উঠতে পারলে একটা না একটা পথ হয়ে যায়।

ভুল হয় যেখানে

মৌসুমি উদ্যোগের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময় টার্গেট ঠিক করতে ভুল হয়ে যায়। ধরুন আমি পাঞ্জাবি বানালাম স্টুডেন্টদের জন্য, দাঁড়িয়ে পড়লাম গুলশান এলাকায়, তাহলে হবে না। ফেসবুক মার্কেটিংটাও ভালোভাবে বুঝতে হবে। আগে ঠিক করতে হবে আমি কার কাছে বেচব। তারপর ঠিক হবে আমি কী বেচব, কীভাবে বেচব, দাম কত হবে ইত্যাদি।