গলি বয়ের গল্প

গানে গানে রানা মৃধার জীবনের গল্প এখন অনেকের জানা। ছবি: খালেদ সরকার
গানে গানে রানা মৃধার জীবনের গল্প এখন অনেকের জানা। ছবি: খালেদ সরকার

 ‘...আমার অনেক ইচ্ছে ছিল স্কুলে যামু/ তিন বেলা পেট ভাইরা ভাত–মাছ খামু/ আমার লাইগা নতুন একটা কালা প্যান্ট কিইনা/ নতুন একটা শাড়ি কিইনা মার হাতে দিমু/ এখন এই সব ইচ্ছা দিছি মনের মধ্যে কবর...’—এমন নির্মম বাস্তবতার কথায় মোড়ানো একটি গান, র‌্যাপ ঘরানার। গানের তালের সঙ্গে দুই হাত দ্রুতলয়ে দুলিয়ে গানটি গাইছে দশ-এগারো বছরের এক শিশু। দোদুল্যমান ছোট্ট শরীরের সঙ্গে সঙ্গে ঈষৎ লম্বা চুলগুলো দুলছে সমানতালে। গায়ে রঙিন টি–শার্ট, গলায় ঝুলছে ইংরেজি ‘আর’ আদ্যক্ষর–সংবলিত একটি চেইন। কখনো সাদা–কালো, কখনো রঙিন; আবছায়া ভিডিও চিত্রে জ্বলজ্বল করছে ছোট্ট এই র‌্যাপশিল্পীর পোড় খাওয়া কঠিন মুখ। ভালো করে তাকালে দেখা যায়, কণ্ঠজাত তেজের ছাপ মুখাবয়বজুড়ে।

ঈদের আগে গানটি যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, ভীষণ চমকে ওঠে মানুষ। মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। ইন্টারনেটের চলতি ভাষায় যাকে বলে ‘ভাইরাল’। এ বছরই মুক্তি পেয়েছে বলিউড চলচ্চিত্র গলি বয়। সেই ছবির গলি বয় ছিলেন অভিনেতা রণবীর সিং, ছবির একটি র‌্যাপ গানের আদলে তৈরি হয়েছে ‘ঢাকাইয়া গলি বয়-আমি রানা’। কে এই রানা নামের শিশু? যদিও গানে গানেই নিজের আপাত পরিচয়টুকু দিয়েছে সে। নাম—রানা, কামরাঙ্গীরচর, পূর্ব রসুলপুরের ৮ নম্বর গলির ‘ঢাকাইয়া গলি বয়’। তবে এই পরিচয়ে মুগ্ধ কৌতূহলী মানুষের কৌতূহলের পারদ বরং ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠে। হাড় জিরজিরে বুকের ভেতর ভবিষ্যতের বারুদ পুষে কঠিনমুখো নির্লিপ্ততায় জীবনের নির্মম বাস্তবতার গল্প বলে চলেছে, কে এই শিশু গল্পকার!

ফুলের মতো জীবনে জীবিকার ভাবনা

রাত শেষে ঘুমক্লান্ত চোখ মেলে কোনো দিন মায়ের মুখটা দেখে, কোনো দিন দেখে না। সকালে ঘুম থেকে কিছুটা দেরি করে উঠলেই মায়ের দেখা আর মেলে না। মা চলে যান রুটিনমাফিক কাজে। মানুষের বাসায় সারা দিন কাজ করে ঘরে ফেরেন রাত দশটায়। সপ্তাহের প্রতিটি দিন। কোনো রকমফের নেই। আর রানা? হ্যাঁ, মায়ের ছোট ছেলে রানা। পুরো নাম রানা মৃধা। বছর তিন–চারের বড় ভাই শামীম মৃধা ওয়ার্কশপের কাজে চলে গেলে বেরিয়ে পড়ে রানাও। কখনো নিঃসঙ্গ, কখনো সদলবলে; চলে আসে শাহবাগ। ফুলের দোকান থেকে স্বল্প বাসি ফুল অল্প টাকায় কিনে নিয়ে অন্য আর দশটা পথশিশুর মতোই দিন শুরু করে। সারা দিন ধরে চলে ফুল আর সুবাসের এই বেচাকেনা। কর্মব্যস্ত সময়ের কোনো এক ফাঁকে গিয়ে হাজির হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, মজার ইশকুলের ক্লাসে। সন্ধ্যা নেমে এলে বাড়ির পথ ধরে।
সারা দিনের ফুলের সুবাস গায়ে মেখে কামরাঙ্গীরচর ৮ নম্বর গলির সুবাসিত ফুলের মতো শিশু রানা গিয়ে হাজির হয় ছোট্ট ঘরটিতে। ফুল বিক্রির টাকা তুলে দেয় মায়ের হাতে। বড় ভাই আর মাকে নিয়ে খুঁড়িয়ে চলা সংসারের বিরামহীন সংগ্রামে এভাবেই দৈনন্দিন অবদান রাখে রানা। বছরান্তে একবার যাওয়া হয় গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরে। সেখানে আছেন বাবা। পেশায় পলো (মাছ ধরার বস্তুবিশেষ) নির্মাতা তিনি।
বাবার কান অবধি এখনো পৌঁছায়নি রানার গান। তবে মা শুনেছেন। একবার নয়, অসংখ্যবার। এই গানের মধ্য দিয়ে স্বপ্নহীন জীবনে নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন মা সিতারা বেগম। যে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ছুটে চলেছিল সন্তানের অনাগত জীবন, সেই অনিশ্চয়তার রাশ টেনে ধরার সাহস পাচ্ছেন তিনি। এখন স্বপ্ন দেখেন, রানা পড়াশোনা করবে। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবে। আর ওর গানের মধ্য দিয়ে সারা জীবন সমাজের এমন অসংগতির কথা তুলে ধরবে। 

মাহমুদ হাসান
মাহমুদ হাসান

আড়ালের কারিগর

দিনের প্রায় পুরোটা সময়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কাটে রানার। বেশ চটপটে, বুদ্ধিদীপ্ত এবং সপ্রতিভ। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মুহূর্তেই ভাব জমিয়ে ফেলতে পারে। এমনই একদিন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সামনে একজনকে বাইক স্টার্ট দিতে দেখে এগিয়ে আসে। আবদার করে বসে বাইকে ওঠার। সপ্রতিভ রানাকে ভালো লাগে বাইকের মালিক মাহমুদ হাসানের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মাহমুদ। নিয়মিত চর্চা করেন র‌্যাপ সংগীতের। বেশ কিছুদিন ধরেই খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন এমন কোনো পথশিশু, যাকে দিয়ে পথশিশুদের জীবনসংগ্রামের গল্প তুলে ধরবেন গানে গানে। সহজাত কৌতূহলে রানাকে তুলে নিলেন বাইকে। মাহমুদ হাসান তাকে গান গাইতে বলার সঙ্গে সঙ্গেই চলন্ত বাইকের পেছনে বসেই গান ধরল রানা। ভরাট গলা, তাল-লয়-সুরের টনটনে বোধ। মাহমুদ হাসান বলেন, ‘ওর গানটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম, আমি এত দিন যাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম পেয়ে গেছি তাকে। তারপর ওর জীবনের গল্প শুনে অল্প সময়ের মধ্যেই লিখে ফেললাম এই গান। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে গানটা কণ্ঠে তুলে আমাকে আরও একবার চমকে দিল রানা। এরপর রেকর্ডিং, সংগীতায়োজন, ভিডিও নির্মাণ সব মিলিয়ে সময় লাগল সাকল্যে সাত দিন। যদিও এর আগেই রানাকে দিয়ে গানটি খালি গলায় গাইয়ে একজন ভিডিও করে ফেসবুকে প্রকাশ করলে হুলুস্থুল পড়ে যায় তখনই। এরপর আসে আমাদের গানটি।’

শুধু পেছনের একজন কারিগর হিসেবেই নয়, একজন দায়িত্বশীল অভিভাবকের মতো রানাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছেন মাহমুদ হাসান। ভাইরাল–যুগের স্বল্প স্থায়িত্বের তারকাখ্যাতি নয়, তিনি বিশ্বাস করেন, রানা বাংলা গানের শ্রোতাদের হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন দখল করবে কোনো একদিন।