আটলান্টিক থেকে লিখছি

প্রধান বিজ্ঞানী ক্যারেনের সঙ্গে লেখক
প্রধান বিজ্ঞানী ক্যারেনের সঙ্গে লেখক
>বিশ্বের ২৩টি দেশের ২৫ জন তরুণ সমুদ্রবিজ্ঞানী এখন জাহাজে ভাসছেন আটলান্টিক মহাসাগরে। দলটি নির্বাচিত হয়েছে বিভিন্ন দেশের প্রায় ৮০০ জন আবেদনকারীর মধ্য থেকে। তাঁদের সঙ্গে আছেন নামজাদা সমুদ্রবিজ্ঞানী আর সমুদ্রবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা। দলটির যাত্রা শুরু হয়েছে ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ থেকে, এক মাসের যাত্রায় তাঁরা পৌঁছাবেন জার্মানিতে। এই দলে আছেন বাংলাদেশের তরুণ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মারুফা ইসহাক। জাহাজ থেকেই লিখে পাঠিয়েছেন তাঁর অভিজ্ঞতা।

গিটার বাজিয়ে লুকাস গান গাইছে। স্প্যানিশ ভাষায় ওর প্রিয় কোনো গান। কফি রুমে আমরা কয়েকজন বসে আছি। আমাদের এখন কিছু বিরতি। কেউ গল্প করছে, কেউ দাবা খেলছে, কেউ আবার কফি হাতে আকাশকুসুম ভাবছে। কফি রুমে বড় বড় দুইটা মনিটর। একটায় জাহাজের গতিপথ দেখাচ্ছে, আরেকটাতে কতক্ষণ পরে লাইফ জ্যাকেট আর হেলমেট পরে জাহাজের ডেকে ছুটতে হবে, সেটার ক্ষণগণনা চলছে।

আটলান্টিক মহাসাগরের ওপরে আমাদের প্রায় দুই সপ্তাহ কেটে গেল। ২৩টি দেশ থেকে আমরা ২৫ জন তরুণ সমুদ্রবিজ্ঞানী এখন জার্মান জাহাজ আরভি পোলারস্টার্নে। আমাদের সব ব্যয় বহন করছে নিপ্পন ফাউন্ডেশন এবং আটলান্টোস। এই আটলান্টিক অভিযানের মূল আয়োজক হলো পার্টনারশিপ ফর অবজারভেশন অব গ্লোবাল ওশান এবং জার্মানির আলফ্রেড ওয়েগেনার ইনস্টিটিউট। 

মই বেয়ে জাহাজে

আমাদের সবাইকে শুরুতে যেতে হয়েছিল চিলির পুনেতে এরেনাস শহরে। সেখানে দুই দিনের কর্মশালা শেষে আমরা বিমানে করে পৌঁছালাম ফকল্যান্ড দ্বীপে। ফকল্যান্ড দ্বীপের পোর্ট স্ট্যানলি থেকে আমরা স্পিডবোটে করে রওনা দিলাম। প্রায় আধা ঘণ্টা চলার পর সমুদ্রের মধ্যে বেশ দূরে মিটিমিটি হলুদ আলো দেখা গেল। ধীরে ধীরে আলো স্পষ্ট হলো। ছোটবেলায় গল্প–কাহিনিতে পড়েছিলাম, পাতাল ফুঁড়ে রাজকন্যা বেরিয়ে এল, আর আমার কাছে মনে হচ্ছিল, এ যেন মহাসমুদ্র ফুঁড়ে উঠে এল একটা আস্ত বড় জাহাজ।

স্পিডবোট জাহাজের কাছে পৌঁছাতেই জাহাজের ডেক থেকে একটা দড়ি, কাঠের মই ফেলা হলো। ঢেউয়ের প্রবল গর্জন, ভীষণ বাতাস আর স্পিডবোটের দুলুনি। এই মই বেয়ে উঠতে পারলে জাহাজ, না পারলে মহাসমুদ্র! তখন সন্ধ্যার নিবুনিবু আলো। দড়ি ধরে কাঠের মইয়ের ওপর একটা পা রেখে টের পেলাম আমার আরেকটা পা রাখার জায়গা খুঁজে পাচ্ছি না। বাতাসের চোটে কোনো রকম ব্যাকরণ ছাড়াই মই শূন্যে দুলছে। অবশেষে মই বেয়ে ডেকে ওঠার পরেই জাহাজের কর্মকর্তা আমাদের পরিচয়পত্র দিয়ে পাসপোর্টটা রেখে দিলেন। 

একপ্রস্থ আরভি পোলারস্টার্ন

সমুদ্রবিজ্ঞান বিষয়ে বিভিন্ন উপাত্ত সংগ্রহ এবং প্রক্রিয়া করার জন্য সব ধরনের আধুনিক যন্ত্রপাতি রয়েছে। মূলত বরফ কেটে আর্কটিক অথবা দক্ষিণ মহাসাগর পাড়ি দিয়ে অ্যান্টার্কটিকার মতো দুর্গম জায়গায় সমুদ্রবিজ্ঞান গবেষণার জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে আরভি পোলারস্টার্ন। এই জাহাজে মোট ছয়টা ডেক আছে। আমাদের থাকার ব্যবস্থা সি-ডেকে। আমার রুমমেট অ্যাঞ্জেলা, এসেছে কলম্বিয়া থেকে। আমাদের রুমে আছে ব্যাঙ্ক বেড, টেবিল-চেয়ার, সোফা, ক্লোজেট, ফ্রিজ, এমনকি লাগোয়া স্নানঘরও। জাহাজে সুইমিংপুল, সাউনারুম, জিম, স্পোর্টস রুম, লন্ড্রি রুম—সবই আছে। মেস রুম (ডাইনিং) আছে দু-একটা ডি ডেকে, আরেকটা সি ডেকে-আমাদের আর কর্মকর্তাদের ব্যবহারের জন্য। মেস রুমের পাশেই লালগালিচা আর লাল সোফা দিয়ে সাজানো কফি রুম। জাহাজের বেশির ভাগ আসবাবই এদিক-ওদিক নাড়ানো যায় না। এমনকি প্লেট-গ্লাস, ল্যাবরেটরির সব ছোট-বড় যন্ত্রপাতি সবকিছুই রাখার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা আছে, যেন জাহাজের দুলুনিতে কিছু ভজকট না হয়। 

জাহাজের হেলিপ্যাডে লেখকসহ (মাঝে ডােন দাঁড়ানো) বিভিন্ন দেশের তরুণ সমুদ্রগবেষকেরা। ছবি: সংগৃহীত
জাহাজের হেলিপ্যাডে লেখকসহ (মাঝে ডােন দাঁড়ানো) বিভিন্ন দেশের তরুণ সমুদ্রগবেষকেরা। ছবি: সংগৃহীত

আটলান্টিকের দিনরাত্রি

প্রথম দিন জার্মান জাহাজের অতি সুস্বাদু খাবার পেট পুরে খেয়ে প্রধান বিজ্ঞানী ক্যারেনের কথা শুনতে শুনতে বুঝলাম যে রীতিমতো ঘুমে ঢুলছি। তার ওপর জাহাজের নিরাপত্তা কর্মকর্তা তার ব্রিফিং শেষে বলে কিনা আমাদের একবার প্র্যাকটিস করাবে। অ্যালার্ম বাজার সঙ্গে সঙ্গে লাইফ জ্যাকেট নিয়ে ছুটতে ছুটতে আমরা হেলিপ্যাডে পৌঁছালাম। এখানে বলে রাখি, আমাদের এই জাহাজে খুব সুন্দর চকচকে দুটো হেলিকপ্টার লুকানো আছে—একটা লাল, আরেকটা কমলা রঙের। হুটহাট যখন গ্যারেজের ঢাকনা কিছুটা খোলা থাকে, তখন সেই হেলিকপ্টার দুটি দেখা যায়। রাতের ঠান্ডা বাতাসে ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখে সেদিন নিরাপত্তা অনুশীলনের পর্ব শেষ করেই আমি ঘুম এবং পরের দিন সি-সিকনেসের শিকার। ডাক্তার দেখিয়ে, গোটা চারেক ট্যাবলেট খেয়ে এক দিন পর আমি অবশ্য বিছানা থেকে উঠতে পারলাম।

আমরা ২৫ জন পাঁচটা দলে কাজ করা শুরু করলাম জাহাজে ওঠার পরের দিন থেকেই। প্রতিটা দলের কাজের ধরন আলাদা। এক সপ্তাহ পরপর প্রতিটা গ্রুপের কাজের ধরন পরিবর্তন হয়। নাসা (আমেরিকা), আলফ্রেড-ওয়াগেনার ইনস্টিটিউট (জার্মানি) এবং আরও কয়েকটা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ১৫ জনের মতো বিশিষ্ট সমুদ্রবিজ্ঞানী আমাদের প্রশিক্ষক হিসেবে এই অভিযানে অংশ নিয়েছেন। বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে সমুদ্রবিজ্ঞানের বিভিন্ন উপাত্ত সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ—এসব নিয়ে আমাদের প্রশিক্ষণ হচ্ছে। মজার ব্যাপার হলো, যেকোনো বিষয়ে হুটহাট গুগল করার কোনো সুযোগ নেই এখানে। আমাদের কম্পিউটার রুমে অনেক কম্পিউটার থাকলেও কেবল দুটি কম্পিউটারে ইন্টারনেট আছে। কাজেই যখন-তখন ইন্টারনেট ব্যবহারের কথা ভাবা যায় না। তবে প্রতি সপ্তাহে অন্তত দুই দিন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমাদের আধা ঘণ্টা আলাপ হয় স্কাইপে। সমুদ্র আর এই আটলান্টিক অভিযান নিয়ে তাদের উৎসাহ আর আগ্রহের কমতি নেই। সারা দিনের ছোটাছুটি আর কাজের শেষে প্রতিদিন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় আমাদের ব্রিফিং হয় বিশাল একটা হলঘরে, তখন কাজের অগ্রগতির ওপর আমাদের প্রেজেন্টেশন দিতে হয়।

জাহাজ চলতে শুরু করামাত্রই বুঝেছিলাম, কেন আমাদের এত শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিয়ে আটলান্টিক অভিযানে নামতে হয়েছে। মহাসমুদ্রের তাণ্ডব–নৃত্যের সঙ্গে ল্যাপটপ খুলে কাজ করা এবং সমুদ্রের রেলিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে, বাতাসের জোরালো ধাক্কা সামলে যন্ত্রপাতি সেট করে উপাত্ত সংগ্রহ করা—এসব কিছু পুরোই ফিল্মি স্টাইলের অ্যাডভেঞ্চার। কখনো আটলান্টিক থেকে উপাত্ত সংগ্রহের জন্য আমাদের রাত তিনটায় উঠতে হয়, কখনো সকাল সাতটায়, কখনো দুপুরে বা সন্ধ্যায় ছুটতে হয়। জাহাজের ডেকে কাজের সময় কখনো দেখা হয় সাদা উড়ুক্কু মাছের (ফ্লাইং ফিশ) সঙ্গে, কখনো অতি আগ্রহী সামুদ্রিক কচ্ছপ আমাদের যন্ত্রপাতির পাশ দিয়ে সাঁতার কেটে যায়। দক্ষিণ আটলান্টিকের প্রচণ্ড শীত থেকে এখন আমরা বিষুবরেখার কাছাকাছি গরম আবহাওয়ার দিকে যাচ্ছি। এরই মধ্যে কয়েক দফা ঘড়ির সময় বদলাতে হয়েছে। আমাদের এই আটলান্টিক অভিযান শেষ হবে ৩০ জুন। সেদিন আমরা জার্মানিতে পৌঁছাব।