তাঁরাও অভিভাবক

সন্তানের মতো ভালোবেসেই বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের খোঁজ রাখেন নৈতিক অভিভাবকেরা। ছবি: সংগৃহীত
সন্তানের মতো ভালোবেসেই বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের খোঁজ রাখেন নৈতিক অভিভাবকেরা। ছবি: সংগৃহীত

‘আমি তাঁকে দেখিনি কখনো। তিনিও দেখেননি আমাকে। কিন্তু মাসান্তে বৃত্তির টাকাটা ঠিক এসে পৌঁছে যায় আমার হাতে। আমি টের পাই, না দেখা সেই মানুষটি অদৃশ্যভাবে সব সময় আমার পাশেই আছেন। আমার আজন্ম কৃতজ্ঞতা সেই নৈতিক অভিভাবকের প্রতি।’

মুঠোফোনের অন্য প্রান্ত থেকে সুমাইয়া আশরাফের কৃতজ্ঞতার অনুভূতি এভাবেই ভেসে আসে। এপ্রান্ত থেকে তাঁর মুখটা দেখা যায় না। কিন্তু চোখ বন্ধ করে তাকালে ঠিক দেখতে পাওয়া যায়, কৃতজ্ঞতাবোধের ঔজ্জ্বল্যে সব মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। কুষ্টিয়ায় অবস্থিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী মেধাবী সুমাইয়া আশরাফ তাঁর বিভাগে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। নৈতিক অভিভাকত্বের মানবিক ধারণাটি তাঁর পিতার মৃত্যুতে ফ্যাকাশে হয়ে আসা স্বপ্নকে আবার রঙিন করে বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে নিয়ে চলেছে।

মাগুরার এক প্রত্যন্ত গ্রামের রাজিব হোসেনের গল্পটিও নাড়া দেয় আমাদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন যখন ধীরে ধীরে দুঃস্বপ্নে রূপান্তরিত হচ্ছিল, ঠিক তখনই একজন ‘মোরাল প্যারেন্ট’ (নৈতিক অভিভাবক) পাশে এসে দাঁড়ান। রাজিব এখন মাৎস্যবিজ্ঞান বিভাগে তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন। ‘আমার নৈতিক অভিভাবক সৌদিপ্রবাসী। যখনই প্রয়োজন হবে, আমি সন্তানের মতোই তাঁর পাশে থাকব আজীবন’—বলছিলেন রাজিব।

শুধু রাজিব হোসেন কিংবা সুমাইয়া আশরাফই নন, সেলিম রেজা, হাবিবুর রহমান, জ্যোতি খাতুন কিংবা রিয়াজুল ইসলাম—এমন আরও অনেক স্বপ্নাহত-স্বপ্নভাঙা মানুষের ফের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প জড়িয়ে আছে ‘নৈতিক অভিভাবকত্ব’ ধারণাটির সঙ্গে।

নৈতিক অভিভাবকত্ব এবং একজন মাহবুবুর রহমান

‘নৈতিক অভিভাবকত্ব’ ইংরেজি ‘মোরাল প্যারেন্টিং’–এর বাংলাকরণ। ২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল অবধি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হয়ে শিক্ষা সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়ানোর কাজ করেন ড. মো. মাহবুবুর রহমান। পেশাগত জীবনের আহ্বানে যখন ছেড়ে আসেন কাজটি, তখনই একটি সুতীব্র অনুভূতি অনুভব করেন নিজের ভেতর। কত অসম্ভব মেধাবী শিক্ষার্থী ঝরে যায় অল্প কিছু অর্থের জন্য! এরপর বৃত্তি নিয়ে জাপানে পড়তে গিয়ে দেখেছেন সে দেশের শিক্ষার্থীদের প্রাচুর্যপূর্ণ জীবন। মালয়েশিয়ায় অধ্যাপনা করতে গিয়ে খুব কাছ থেকে দেখেছেন সে দেশের শিক্ষার্থীদের। তখন থেকেই প্রাপ্ত বৃত্তির একটি ছোট অংশ কিংবা উপার্জিত অর্থের একটি নির্দিষ্ট অঙ্ক পাঠাতেন মায়ের কাছে। মা সেই টাকা দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন কিংবা কিনে দিতেন শিক্ষাসরঞ্জাম। একসময় বুঝতে পারলেন, বিদেশ–বিভুঁই থেকে কিছু অর্থসাহায্য পাঠিয়ে খুব একটা কার্যকরী উপকার করতে পারছেন না। সত্যিকারভাবেই ফলপ্রসূ কিছু করতে হলে খুব কাছ থেকে নিবিড়ভাবে করতে হবে। দেশে ফিরে আসার অন্যান্য কারণের সঙ্গে এ বিষয়টিও গভীরভাবে জড়িয়ে যায়। দেশে ফিরে এসে ২০১৬ সালের জুলাই মাস থেকে নৈতিক অভিভাবকত্বের ধারণাটি নিয়ে আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু করেন।

প্রথমে নিজের ঘনিষ্ঠজনদের কাছে তুলে ধরেন ধারণাটি। বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থী খুঁজে বের করে সচ্ছল সহৃদয় কোনো বন্ধুকে অনুরোধ করেন অন্তত একজন শিক্ষার্থীর দায়িত্ব নিতে। ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব যখন সাড়া দিতে শুরু করলেন, বুকে সাহস পেলেন মাহবুবুর রহমান। একসময় বন্ধুর বন্ধু, তাঁদের পরিচিতজন এবং ধীরে ধীরে অপরিচিতজন অনেক মানবিক মানুষ এগিয়ে এলেন।

মানবিক এবং সংগ্রামমুখর মানুষদের মিলনস্থল

নৈতিক অভিভাবক এবং নৈতিক সন্তানদের মধ্যে একটি মানবিক সেতুবন্ধ মোরাল প্যারেন্টিং প্রত্যয়টি। এই কর্মযজ্ঞের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রত্যেক মানুষ যেমন মানবতার আলোয় উদ্ভাসিত, তেমনি সংগ্রামমুখর জীবনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। বর্তমানে ৯০ জন নৈতিক অভিভাবক ২০০ জনের অধিক মোরাল চাইল্ডের (নৈতিক সন্তান) দায়িত্ব পালন করছেন। এই অভিভাবকদের অধিকাংশই জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে সংগ্রাম করে সংগ্রামে সফল হয়েছেন। ফলে জীবন নিয়ে নিরন্তর সংগ্রাম করে চলা শিক্ষার্থীদের প্রতি একধরনের নৈতিক দায়বদ্ধতাই যেন অনুভব করেন তাঁরা।

ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে দেওয়া হয় এই বৃত্তি। বৃত্তির টাকার অঙ্কটি খুব বেশি নয়। কিন্তু অঙ্কের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গড়ে ওঠা সম্পর্ক। যে সম্পর্ক শুধু বৃত্তি দান-গ্রহণে সীমাবদ্ধ নয়, বরং পিতামাতা-সন্তানের এক চিরায়ত সম্পর্ক। হুলুস্থুল জীবনের কাজ ফুরিয়ে যায় একসময়, ব্যস্ততা কমে যায়, ধীরে ধীরে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে মানুষ, প্রিয়জনেরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে। সেই নিঃসঙ্গ সময়ে এই অগণন নৈতিক সন্তানদের কেউ না কেউ নিশ্চয়ই পাশে এসে দাঁড়াবে। নৈতিক সন্তানেরা নিয়মিত চিঠি লিখে নিজেদের কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা জানায় নৈতিক অভিভাবকদের। মাঝেমধ্যে মুঠোফোনে যোগাযোগ, অভিভাবকদের দিকনির্দেশনা শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণার এক অনুপম উৎস যেন। ৪ মে মোরাল প্যারেন্টিংয়ের সাত সদস্যবিশিষ্ট ট্রাস্টি বোর্ড গঠিত হয়েছে। জনপ্রিয় অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী যুক্ত হয়েছেন উপদেষ্টা হিসেবে। নৈতিক সমাজ গঠনের প্রত্যয়ে এই মানবিক আহ্বানে এগিয়ে আসছেন আরও অনেকেই।

নৈতিক অভিভাবক হওয়ার জন্য অর্থের প্রাচুর্য নয়, বরং মানবিক হৃদয়ের অধিকারী হওয়া চাই—বলছিলেন ড. মাহবুব। সৎ পথে উপার্জিত অর্থ দান-দক্ষিণার মানসিকতায় নয়, বরং নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকেই প্রতিটি মোরাল প্যারেন্ট দায়িত্ব নিয়ে থাকেন। কতগুলো প্রতিশ্রুতি রয়েছে নৈতিক সন্তানদেরও। প্রাপ্ত বৃত্তি শুধুই শিক্ষার কাজে ব্যয় করা, কোনো অনৈতিক কাজে না জড়ানো কিংবা নিজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ঠিক একইভাবে অন্তত দুজন নৈতিক সন্তানের দায়িত্ব নেওয়া—এমনই সব প্রতিশ্রুতি।

৯০ শতাংশ তত্ত্ব

জীবনের শতভাগের সবটুকু শুধুই নিজের জন্য ব্যয় করে কতটুকু সুখী হতে পারে মানুষ। নিজের পরিবার–পরিজন, সন্তানসন্ততি—সবার জন্য শতভাগ দিয়েও একটি শতভাগ সুখী জীবন কি নিশ্চিত করা যায়! বরং ব্যাপারটি যদি এমন হয়, ৯০ ভাগ থাকুক নিজের পরিবার–পরিজনের জন্য, বাকি দশ ভাগ থাকুক সমাজের জন্য, পরের জন্য। নিজ মেধা, শ্রম, অর্থ এবং সময়—সবকিছুর ১০ শতাংশ ব্যয়িত হোক পরার্থে। তাহলে একটি অর্থপূর্ণ আনন্দময় জীবন বোধ হয় পাওয়া যেতে পারে। এভাবেই ৯০ শতাংশ তত্ত্বের ব্যাখ্যা করছিলেন তত্ত্বের উদ্ভাবক মো. মাহবুবুর রহমান। যে তত্ত্বটি মোরাল প্যারেন্টিং ধারণাটির অন্যতম অনুঘটক।