আহা ফাইনাল

সেই রুদ্ধশ্বাস মুহূর্ত—নিউজিল্যান্ডের মার্টিন গাপটিলকে রানআউট করলেন ইংল্যান্ডের জস বাটলার। তাতেই তো বিশ্বকাপ ট্রফি জয়ের স্বপ্নটা সত্যি হলো ইংলিশদের। ছবি: এএফপি
সেই রুদ্ধশ্বাস মুহূর্ত—নিউজিল্যান্ডের মার্টিন গাপটিলকে রানআউট করলেন ইংল্যান্ডের জস বাটলার। তাতেই তো বিশ্বকাপ ট্রফি জয়ের স্বপ্নটা সত্যি হলো ইংলিশদের। ছবি: এএফপি

বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনাল নাকি জমে না। নিউজিল্যান্ড ২৪১ রান করার পর সাদা চুলের এক ভারতীয় সাংবাদিকও সে কথাই আবার মনে করিয়ে দিলেন, ‘বলেছিলাম না, জমবে না!’ কিন্তু সে ফাইনালই গেল জমে। হয়ে গেল টাইয়েরও টাই। ৫০ ওভার শেষে নিউজিল্যান্ড ২৪১, ইংল্যান্ড ২৪১। সুপার ওভারে ইংল্যান্ডের ১৫ রান, নিউজিল্যান্ডেরও ঠিক তাই। বিশ্বকাপের এমন ফাইনাল কে দেখেছে এর আগে! লর্ডসের প্রেসবক্সে বসে বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখাটা এমনিতেই ভবিষ্যতে বলার মতো ঘটনা। তার ওপর কিনা এ রকম এক ফাইনাল, বিশ্বকাপ ইতিহাসেরই সেরা ফাইনালের মর্যাদায় যেটি কিনা উঠে গেল প্রায়। এমন ফাইনাল দেখা তো সাত জন্মের পুণ্যের ফসল।

খেলা শেষে লর্ডস থেকে ঘোর লাগা চোখে বাড়ি ফিরেছে মানুষ। কে চ্যাম্পিয়ন হলো আর কে রানার্সআপ, সেটি যেন আর কারও মাথাতেই নেই। সবার মধ্যে বিস্ময়ের ঘোর। উত্তেজনায় ডেইলি স্টার–এর ক্রীড়া সাংবাদিক সাকেব তাহসিন সোবহানের লেখাই রুদ্ধ হয়ে পড়ল। একটু পর পর ল্যাপটপ ছেড়ে হাতে হাত চাপড়ে উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলতে লাগলেন, ‘কী দেখলাম! এটা কীভাবে সম্ভব?’

ক্রিকেট অনিশ্চয়তার খেলা, ঠিক আছে। কিন্তু সে অনিশ্চয়তার দৌড় কতটা? ম্যাচ টাই হতে পারে, সুপার ওভারে যেতে পারে...এই তো? হয়তো শেষ ওভারে ১ উইকেট হাতে রেখেই কোনো দল ২০-২২ রান করে ফেলল বা প্রতিপক্ষকে ১ ওভারে ১ রানের লক্ষ্যও স্পর্শ করতে দিল না। কোনো ম্যাচ এ পর্যন্ত গেলেই তো সে এক অসামান্য ক্রিকেটীয় মেলোড্রামা। সেখানে এক ম্যাচেই দুই–দুইবার টাই? এ তো অতিনাটকীয়তার পক্ষেও বড্ড বেশি বাড়াবাড়ি!

বলের চেয়ে রান দরকার দ্বিগুণ। এমন সময়ে রান আউট থেকে বাঁচতে ডাইভ দেওয়া ব্যাটসম্যানের ব্যাটে লেগে ওভার থ্রো থেকে হয়ে গেল ৪ রান। ফিল্ডার ক্যাচ নিয়েও সীমানার রশিতে পা দিয়ে সেটিকে বানিয়ে দিলেন ছক্কা। এরপর সুপার ওভারে ইংল্যান্ডের করা ১৫ রান টপকাতে হবে নিউজিল্যান্ডকে! বিশ্বকাপ ফাইনাল কেন, ওয়ানডে ক্রিকেটেও কি এর আগে এমন রোমাঞ্চ কেউ দেখেছে?

ঘরের মাঠে ইংল্যান্ডের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দের চেয়ে বড় হয়ে গেল ফাইনালের অবিশ্বাস্য শেষ দৃশ্য। সুপার ওভারের শেষ বলে দ্বিতীয় রান নিতে গিয়ে নিউজিল্যান্ডের ব্যাটসম্যান মার্টিন গাপটিল রান আউট। ইংল্যান্ডের ফিল্ডারদের উল্লাস তো সীমা ছাড়িয়ে যাবেই! রান আউটটা না হয়ে ২ রান হয়ে গেলে চ্যাম্পিয়ন হয়ে যেত নিউজিল্যান্ড। শিরোপায় ভাগ হয়তো সেদিন তাদেরও প্রাপ্য ছিল, কিন্তু অদ্ভুত নিয়মটা যে আগেই করা! সুপার ওভারও টাই হলে যে দল বেশি বাউন্ডারি মেরেছে, তারাই হবে জয়ী। ঘরের মাঠের বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে ইংল্যান্ড চ্যাম্পিয়ন হলো না, হলো নিয়মের মারপ্যাঁচে।

তবে এই ম্যাচে ক্রিকেট দেখিয়ে দিল খেলাটি কীভাবে অনিশ্চয়তার শেষতম বিন্দু পর্যন্ত যেতে পারে।

দাম অনেক বেশি দেখে এক বাংলাদেশি দর্শক ফাইনালের টিকিট কিনতে পারেননি। স্টেডিয়ামের সামনে সারা দিন ঘুরঘুর করে শেষ বেলায় ২০০ পাউন্ড দিয়ে টিকিট কিনে গ্যালারিতে ঢুকেছেন। ম্যাচ দেখার সুযোগ মিলেছে মাত্র শেষ ১৫ ওভার। তিনি কি জানতেন, ফাইনালের অতিনাটকীয় রোমাঞ্চটুকুর বরাদ্দ ছিল ওই শেষ ভাগেই! ২০০ পাউন্ডে বিশ্বকাপ ইতিহাসের সেরা রোমাঞ্চ গায়ে মেখে বাড়ি ফেরা ওই তরুণটি নিঃসন্দেহে সেদিন ছিলেন লর্ডসের সবচেয়ে ভাগ্যবানদের একজন।

সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য তো ইংল্যান্ডেরই। পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকা ভাগ্যটা আরও একটি ফাইনালে তাদের ট্রফি–বঞ্চিত করেনি। আর বিষণ্নতা শুধুই নিউজিল্যান্ডের। ওয়ানডে ক্রিকেটকে সেরা মুহূর্তটি উপহার দিয়েও সে আনন্দের ভাগ নিতে পারল না দলটি। সংবাদ সম্মেলনে নিউজিল্যান্ডের অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসনের কথার অভিমানী সুর বুঝতে অসুবিধা হয়নি কারও, ‘সবাই খেলাটা খুব উপভোগ করেছেন, তাই না? আমাদের চেয়ে ইংলিশদেরই বেশি ভালো লাগার কথা এটা। সন্দেহ নেই, অসাধারণ এক ম্যাচ হয়েছে। কিন্তু এসব ম্যাচ মধুর লাগে ফলটা পক্ষে এলে। উল্টো পাশে থাকলে বিষাদই বেশি।’

সংবাদ সম্মেলনজুড়েই উইলিয়ামসনের মুখে হাসি ছিল। তাঁকে হাততালি দিয়ে বিদায় দেওয়ার সময়ও হাসছিলেন নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক। কিন্তু হাসিতে মিশে ছিল বেদনার নীলচে আভা।