আমার বিশ্বকাপ

ম্যাচ শুরুর আগে জাতীয় সংগীত গাইছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সদস্যরা। ছবি: লেখক
ম্যাচ শুরুর আগে জাতীয় সংগীত গাইছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সদস্যরা। ছবি: লেখক

১৯৯৯ থেকে ২০১৯। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ২০ বছর, আমারও তা-ই। মধ্যে ২০০৭ বিশ্বকাপ বাদে ক্রিকেটের প্রতিটি মহা আসরেই হাজির হয়েছি, শিরোপা জেতার লড়াই সামনে থেকে দেখেছি। তবে এবারের বিশ্বকাপে যাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়েছিলাম আসরটা বিলেতে বলেই, এখানেই যে সূচনা হয়েছিল আমাদের বিশ্বকাপযাত্রা।

কিন্তু ভিসা-জটিলতায় যাত্রা দেরি হচ্ছিল। দিন যত গড়াচ্ছিল, না যাওয়ার সংশয় বাড়ছিল, বাড়ছিল আমার অস্থিরতাও। খেলা চলছে, বাংলাদেশ দল মাঠে—এ যেন আমি নিতেই পারছিলাম না।

অবশেষে ১০ জুন ঢাকা থেকে উড়োজাহাজে উঠে বসি। ১৬ ঘণ্টার যাত্রা শেষে যুক্তরাজ্যের হিথরো বিমানবন্দরে নেমেই ব্যাগ-পোঁটলা নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে যাই। আমার গন্তব্য অবশ্য হোটেলকক্ষ ছিল না, ছিল ব্রিস্টলের স্টেডিয়াম। ততক্ষণে ১১ জুন, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বিশ্বকাপের মহা গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচটির গায়ে বিলম্বের নিশান উড়িয়েছে বৃষ্টি। প্রেসবক্সে না গিয়ে গ্যালারির দর্শকদের ছবি তোলা শুরু করলাম, বৃষ্টিভেজা মাঠের ছবি তুললাম, দলের ড্রেসিংরুমে ফিরে যাওয়ার ছবি তুললাম—ছবি তুলতে তুলতে কখন কাকভেজা হয়েছি, খেয়ালই করিনি। যেমন খেয়াল করিনি ফটোসাংবাদিক হিসেবে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার বিষয়টাও। যখন মনে পড়ল, তখন সেদিকেই ছুটলাম। সেখানে বাধল বিপত্তি। সেই বিপত্তির কথা না হয় অন্য কোনো সময় বলা যাবে! আপাতত বলে নিই, এভাবেই শুরু হয়েছিল আমার বিলেতে ব্যস্ততম দিনগুলো।

টন্টনে ক্রিস গেইলের সঙ্গে
টন্টনে ক্রিস গেইলের সঙ্গে

জল গড়াল চোখের কোণে
ফটোসাংবাদিক হিসেবে দেশে-বিদেশে বাংলাদেশ দলের সঙ্গে অনেক টুর্নামেন্টের ছবি তুলেছি। প্রতিটি ম্যাচেই জাতীয় সংগীতের সময় দাঁড়িয়ে পড়ি। কণ্ঠ মেলাই। কিন্তু এমনটা কখনোই হয়নি। টন্টনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে ম্যাচ ছিল সেটা। জাতীয় সংগীত শুরু হতেই আমার কণ্ঠ ধরে এল, একসময় খেয়াল করলাম, আমি কেঁদেছি।

কেন এমন হয়েছিল, এর কারণ আমি খুঁজে পাইনি। তবে ধারণা করতে পারি, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ম্যাচটি পরিত্যক্ত হওয়ার পর বিশ্বকাপে সেটাই ছিল আমার প্রথম ম্যাচ। এই বিশ্বকাপ আসর নিয়ে সমর্থক হিসেবে আমার প্রত্যাশা ছিল বেশি, সে জন্যই হয়তো।

বসের সঙ্গে দেখা

টন্টনে সেদিন অনুশীলন করছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল। ক্যামেরা কাঁধে গেলাম ছবি তুলতে। কিন্তু প্রবেশপথে আটকে গেলাম। পুরো বিশ্বকাপ আয়োজনে নিরাপত্তার নামে এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে, কখনো কখনো দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। তবে যা-ই হোক, শেষ পর্যন্ত ঢুকতে পারলাম। ঢুকেই দেখি ‘বস’ প্র্যাকটিস করছেন। ছবি তুলছিলাম। একটু পরই তিনি এগিয়ে এলেন, ‘বিগ বেলি ম্যান’ বলে সেই পরিচিত ভঙ্গিতে কুশল জিজ্ঞাসা করলেন ক্রিস গেইল। আমি তাঁকে বস বলেই সম্বোধন করি। তাঁর সঙ্গে এই সম্পর্কের সূত্রটা খুলনার টেস্ট সিরিজের সময়। সম্ভবত সেটা ২০১৫ সাল ছিল। ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের ছবি তুলতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে আন্তরিকতা।

ক্রিস গেইলের এটাই ছিল শেষ বিশ্বকাপ। সেদিন আলাপ শেষে অভিনন্দন জানিয়ে বসের সঙ্গে একটা সেলফিও তুলে রাখলাম।

মাশরাফিকে খুঁজে ফিরি
মাশরাফিকে খুঁজে ফিরি

মাশরাফিকে খুঁজে ফিরি
বাংলাদেশ দলই আমার ঠিকানা। সকালে ঘুম থেকে উঠেই হাজির হতাম টিম হোটেলে কিংবা বাংলাদেশ দল যেখানে অনুশীলন করত, সেখানে। আর যেদিন ম্যাচ থাকত, সেদিন তো মাঠেই।

এমনই একদিন ছিল সেটা। বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচ পরদিন। লর্ডসে অনুশীলন চলছে। বাংলাদেশ দলের সবাই প্রায় অংশ নিয়েছে। শুধু মাশরাফিকে দেখি না। ক্যামেরায় খুঁজে ফিরি তাঁকে, কিন্তু কোথাও দেখা পাই না। বাতাসে ভাসছে সেই ম্যাচে মাশরাফির না খেলার গুঞ্জন। তাহলে কি সে উড়ো সংবাদই সত্যি? না, আশঙ্কা সত্যি হয়নি। এখন সবাই জেনে গেছেন মাশরাফি সে ম্যাচে খেলেছিলেন। নিরাপত্তার ঘেরাটোপে থাকায় এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে অবশ্য সরাসরি কথা হয়নি, তবে সেদিনের ব্যাপারটা নিয়ে প্রশ্নটা এখনো মনের ভেতর জমা আছে।

শহর থেকে শহরে

টন্টন, নটিংহাম, সাউদাম্পটন, বার্মিংহাম অতঃপর লন্ডন। যুক্তরাজ্যের এক শহর থেকে ছুটে গেছি অন্য শহরে। পথে পথে হাজারো অভিজ্ঞতা। হোটেলকক্ষ আগে থেকে ঠিক করা ছিল না বলে বেশ ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। এ কারণে পেয়েছি অনেক মানুষের সহায়তা। ফুরসত ছিল না বলে আলাদা করে ঘোরার সময় করতে পারিনি। স্টোনহেঞ্জে ঘোরার কথা আলাদা করে মনে থাকবে।

আগামী বিশ্বকাপে ছবি তোলার উজ্জ্বল স্মৃতি নিয়ে হয়তো আবার লিখব, আপাতত প্রত্যাশা সেটুকুই।

অনুলিখিত