এক স্কুলে অজস্র গানের গুণী

স্কুলের লাগোয়া খেলার মাঠ ও তার পাশে বুড়ো বটগাছ। সেই গাছের নিচে আমাদের গানের নিয়মিত আসর জমত টিফিনের ছুটিতে। ...গাইতাম-খোলা মাঠে, পাশে ধর্মসাগর দীঘি, বড় বড় গাছের তলায় রোদে, বৃষ্টিতে, ঝড়ে, বাদলে, শীতে, কী আনন্দই না পেয়েছি প্রকৃতির কোলে মাটির গান গেয়ে দিন কাটিয়ে। (সূত্র: শচীন কর্তার জীবন ও গান, শ্যামল চক্রবর্তী, ২০০১)
বাংলা গানের কিংবদন্তি শচীন দেববর্মন (১৯০৬-১৯৭৫) তাঁর বাল্যের প্রিয় কুমিল্লা জিলা স্কুলকে স্মৃতিতে এভাবেই সমুজ্জ্বল রেখেছেন। জিলা স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে ১৯২০-এ মাধ্যমিক পাস করেন তিনি। ১৯১৬-তে বাবা নবদ্বীপ কর্তার শেখানো গান স্কুলের সরস্বতীপূজার অনুষ্ঠানে গেয়ে প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে প্রশংসাও পেয়েছেন। উত্তরকালে সংগীতের সুধা দিয়ে তিনি আমাদের মাঝে মুগ্ধতার যে আবেশ ছড়ান, তার বীজ বুনেছিল কুমিল্লা জিলা স্কুলের উর্বর প্রান্তর।
শিক্ষানুরাগী হেনরি জর্জ লেসিস্টার (১৮০৮-১৮৭০) কুমিল্লা ধর্মসাগর দিঘির পূর্ব পাড়ের দক্ষিণাংশে একটি বাংলো ঘরে চল্লিশের মতো ছাত্র নিয়ে ১৮৩৭-এর ২০ জুলাই যে কুমিল্লা জিলা স্কুলের প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু করেছিলেন, তার ছাত্রসংখ্যা এখন দুই হাজার ছাড়িয়েছে। 
শচীন দেববর্মন ছাড়াও এই স্কুলের অগণন গুণী ছাত্রের মধ্যে গানের গুণীদের কথা বিশেষ করে বলার মতো এবং বিস্ময়াবহও বটে। এঁদের মধ্যে আছেন—সুরসাগর হিমাংশু দত্ত, গীতিকার অজয় ভট্টাচার্য, গীতিকার সুবোধ পুরকায়স্থ, রবীন্দ্রসংগীতজ্ঞ পরিমল দত্ত, নজরুল সংগীতজ্ঞ সুধীন দাশ, সংগীতসাধক মোবারক হোসেন খান, গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার, শিল্পী আপেল মাহমুদ, আসিফ আকবরসহ অনেকে। 
কুমিল্লা জিলা স্কুল থেকে ১৯২৪ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হিমাংশু দত্ত (১৯০৮-১৯৪৪) সুরে রাগসংগীতের প্রাধান্য এবং করুণরসের বৈশিষ্ট্য উল্লেখযোগ্য। উত্তরকালে তিনি সম্মানিত হয়েছেন ‘সুরসাগর’ উপাধিতে। 
কুমিল্লা জিলা স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র প্রখ্যাত কবি ও গীতিকার অজয় ভট্টাচার্য প্রায় দুই হাজার গানের রচয়িতা এবং চলচ্চিত্রকার। আজও ওঠে চাঁদ তাঁর রচিত গানের বই। তাঁর রচিত গানে সুর করেছেন হিমাংশু দত্ত। হিমাংশু সুরারোপিত এবং অজয় ভট্টাচার্য রচিত উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছে ‘বরষার মেঘ ডাকে ঝড় বরিষনে’, ‘মম মন্দির’, ‘আলোছায়া দোলা’, ‘তুমি তো বন্ধু জানো’। 
রবীন্দ্রসংগীতজ্ঞ পরিমল দত্তও (১৯০১-১৯৯১) কুমিল্লা জিলা স্কুলের ছাত্র। স্বদেশি আন্দোলনের এই নিষ্ঠ কর্মী আজীবন রবীন্দ্রসংগীত চর্চা ও সাধনা করেছেন এবং প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। রবীন্দ্রসংগীতের সুর, তাল ও লয় সন্ধানে তাঁর প্রভূত জ্ঞান ছিল বিধায় তাঁকে উচ্চাঙ্গসংগীতের ভাষায় ‘গান্ধর্ব’ আখ্যায়িত করা হতো।
সুবোধ পুরকায়স্থ (১৯০৫-১৯৮৪) কুমিল্লা জিলা স্কুলে পড়ার সময় থেকেই গান লেখা শুরু করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গান ‘পড়ে গেছ তুমি ধরা’, ‘খুঁজে দেখা পাইনি যাহার’, ‘মিলনে সে ছিল দূরে দূরে, বিরহে সে ধরা দিল প্রাণে’, ‘বল হিম ঋতু বল’, ‘ধীর ধীর চরণে’, ‘আজি মধুরাতে কার বাঁশি বাজে হায়’, ‘ডাক দিয়ে যায় কে গো আমায় বাজিয়ে বাঁশি’। তিনি তাঁর কুমিল্লা জিলা স্কুলের বন্ধু হিমাংশু দত্তের জন্যই গান লিখতেন প্রধানত। কলকাতা রেডিওতে এবং হিজ মাস্টার্স ভয়েসে তাঁর লেখা এবং হিমাংশুর সুরারোপিত গান অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। 
এই স্কুলের আরেক কৃতীমান ছাত্র সুধীন দাশ (১৯৩০-২০১৭) নজরুলগীতির কিংবদন্তি পুরুষ; শিক্ষক ও সংগঠক। কাজী নজরুল ইসলামের গানের এই স্বরলিপিকার শুদ্ধ নজরুলগীতি চর্চায় এক পথিকৃতের নাম। 
সংগীতব্যক্তিত্ব মোবারক হোসেন খান প্রখ্যাত উচ্চাঙ্গ সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁর পুত্র। তিনিও শিক্ষাজীবনের এক বিশেষ পর্ব কাটিয়েছেন কুমিল্লা জিলা স্কুলে। তাঁর সংগীতবিষয়ক গ্রন্থের মধ্যে আছে, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ও তাঁর পত্রাবলি, বাদ্যযন্ত্র প্রসঙ্গ, সংগীত প্রসঙ্গ, সংগীত সাধনা, রাগসংগীত, যন্ত্রসাধন, সংগীত গুণীজন, সংগীত মালিকা, ওস্তাদ আয়াত আলী খাঁ, কণ্ঠসাধন ইত্যাদি।
কুমিল্লা জিলা স্কুলের ছাত্র গাজী মাজহারুল আনোয়ার বাংলাদেশের প্রখ্যাত গীতিকার ও চলচ্চিত্রকার। তাঁর অসংখ্য জনপ্রিয় গানের মধ্যে ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’, ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’, ‘শুধু গান গেয়ে পরিচয়’, ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি’, ‘একি সোনার আলোয়’, ‘অশ্রু দিয়ে লেখা’, ‘আমি রজনীগন্ধা ফুলের মতো’, ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’। 
 ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’সহ বহু স্মরণীয় গানের শিল্পী আপেল মাহমুদ এবং ‘ও প্রিয়া তুমি কোথায়’ গানের জনপ্রিয় শিল্পী আসিফ আকবরও কুমিল্লা জিলা স্কুলের ছাত্র।
আজকের দিনে ২০১৯-র ২০ জুলাই ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক কুমিল্লা জিলা স্কুল তার প্রতিষ্ঠার ১৮২ বছর পূর্ণ করল। প্রায় দুই শতাব্দী যাবৎ জ্ঞানের অনির্বাণ আলোকশিখা ছড়িয়ে যাওয়া এই বিদ্যালয়ের ইতিহাস শুধু তার নিজের ইতিহাসই নয়, আমাদের সামগ্রিক শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক ইতিহাসেরও তাৎপর্যপূর্ণ অংশ। 
শুভ ১৮২, কুমিল্লা জিলা স্কুল। 

লেখক: ২০০০ ব্যাচের শিক্ষার্থী, কুমিল্লা জিলা স্কুল