সাঁতার শেখাতে শ্রীপুরে

শ্রীপুরের টেংরা গ্রামে বেকি
শ্রীপুরের টেংরা গ্রামে বেকি
বেকি হর্সব্রো পেশায় সাংবাদিক। শখের সাঁতারু। প্রথম ব্রিটিশ নাগরিক হিসেবে বঙ্গোপসাগরের বাংলা চ্যানেল জয় করেছেন। বাংলাদেশে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে সচেতনতা তৈরির কাজ করছেন। গাজীপুরের শ্রীপুরে শিশুদের সাঁতার প্রশিক্ষণেও যুক্ত আছেন তিনি।

পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার কমাতে সচেতনতা তৈরি করছেন বেকি হর্সব্রো। তবে এই একবাক্যে তাঁর কাজের পুরোটা বোঝা যায় না। চলচ্চিত্রে যেমন ফ্ল্যাশব্যাক দেখানো হয়—সাদাকালো ফ্রেমে অতীতের ঘটনা। ফ্ল্যাশব্যাকে আমরাও বরং বছর দেড়েক আগের ঘটনা জেনে নিই—বেকি যেবার প্রথম বাংলাদেশে এলেন।

সাঁতার যাঁর আশ্রয়

ব্রিটিশ নাগরিক বেকি পেশায় সাংবাদিক। শখের সাঁতারু। তাঁর ভাষায়, ‘সাঁতার আমার আশ্রয়। দিন শেষে পানির হাতে নিজেকে ছেড়ে দিই।’ গুগল ঘেঁটে বেকি একদিন জানলেন, যে পানি তাঁর শখের আশ্রয়, সেই পানির কারণেই অনেক শিশুর জীবন বিপন্ন হচ্ছে। সংবাদমাধ্যমে দেখলেন, বাংলাদেশে দিনে অন্তত ৪০ জন শিশু মারা যায় পানিতে ডুবে।

বেকি সাহায্যের পথ খুঁজতে থাকেন। সবচেয়ে জরুরি ছিল সচেতনতা তৈরি। এরপর বাংলা চ্যানেলের খোঁজ পেলেন। প্রথম ব্রিটিশ নাগরিক হয়ে বাংলা চ্যানেল জয় করে রীতিমতো সাড়া ফেলে দেন। সেখানেই থেমে থাকেননি। বাংলাদেশের শিশুদের সাঁতার শেখানোর উদ্যোগ নেন। সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশের (সিআইপিআরবি) হয়ে অর্থ সংগ্রহ শুরু করেন। এদিকে বেকির আহ্বানে এগিয়ে আসে ব্রিটিশ দাতব্য সংস্থা শ্রীপুর ভিলেজ। গাজীপুরের শ্রীপুরের শিশু পল্লী প্লাস সংস্থার উদ্যোগেই শুরু হয় ‘সুইম সেফ’ (নিরাপদ সাঁতার) কার্যক্রম

ছেড়ে দিলেন চাকরি

এবার ফিরে আসি বর্তমানে—ঢাকায় প্রথম আলো কার্যালয়ে মুখোমুখি বেকি। শিশুমৃত্যু রোধে সচেতনতা তৈরিতে সুবিধা হবে বলে সংবাদ সংস্থা দ্য অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন বছরখানেক হলো। তবে সাংবাদিকতা ছাড়েননি বেকি। বললেন, ‘এখন আমি ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। একদিকে জীবনযাপনের ব্যয়ভার বহন, অন্যদিকে সচেতনতা তৈরি—দুটির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা সহজ হয়েছে।’

এলেন বর্ষার নিমন্ত্রণে

বেকির এবারের বাংলাদেশ ভ্রমণের একটা কারণ হলো বর্ষাকাল। তাঁর ভাষায় ‘সাঁতারের মৌসুম’। তা ছাড়া গাজীপুরের শ্রীপুরে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে শিশুদের সাঁতার প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। ‘বাংলাদেশের আসার এর চেয়ে ভালো সময় আর কী হতে পারে?’

তো কেমন চলছে প্রশিক্ষণ? কর্মব্যস্ত দিন কাটিয়েছেন বেকি। চেহারায় তার ছাপ স্পষ্ট। তবে হঠাৎ কথা বলতে বলতে উৎসাহ নিয়ে বললেন, ‘সকাল সকাল শিশুরা আসছে, তাদের মায়েরাও আসছেন। বেশ একটা কিন্ডারগার্টেনের মতো ব্যাপার। এরা আর্থিকভাবে অসচ্ছল। তবে আগ্রহের কোনো কমতি নেই। এই শিশুদের সবচেয়ে ছোটটার বয়স মাত্র ছয় বছর।’

প্রথম আলো কার্যালয়ে বেকি হর্সব্রো। ছবি: সাবিনা ইয়াসমীন
প্রথম আলো কার্যালয়ে বেকি হর্সব্রো। ছবি: সাবিনা ইয়াসমীন

দুই সপ্তাহেই শিখে যাচ্ছে সাঁতার

সিআইপিআরবির পদ্ধতিতে শ্রীপুরে শিশুদের সাঁতার শেখানো হচ্ছে। দুই সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন আধঘণ্টার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। শেষ হলে পরীক্ষা নেওয়া হয়। এই পরীক্ষার তিনটি অংশ। প্রথম অংশে ২৫ মিটার সাঁতরে যেতে হয়। এরপর ৩০ সেকেন্ড ভেসে থাকার পালা। সর্বশেষ অংশে দেখা হয় বিপদ থেকে নিরাপদ থাকতে পারছে কি না কিংবা আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে কি না।

কেমন করছে শিশুরা? ‘শিশুরা তো দারুণ’—শিশুদের মতোই উচ্ছ্বাস নিয়ে বললেন বেকি। যোগ করলেন, ‘পানিতে যেতে ভয় পায় না। ভেসে যাওয়া এবং পা ঝাপটানোর
অনুশীলন করছে। বয়স ছয়ের বেশি হলে, আমি বলব, দুই সপ্তাহে ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ শিশু সাঁতার শিখে যাচ্ছে।’

ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট হিসেবে দীর্ঘদিন অনেক নামী সংবাদমাধ্যমে কাজ করেছেন বেকি। তাঁর কাজের ক্ষেত্র ছিল ক্রীড়া। তবে তাঁর কাছে ক্রীড়া থেকে সাঁতার আলাদা। কারণও ব্যাখ্যা করলেন বেকি, ‘আপনি ক্রিকেট বা ফুটবল খেলতে না জানলেও সমস্যা নেই। কিন্তু সাঁতার না জানলে হয়তো সেটাই একদিন বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর সাঁতার শেখার কোনো বয়স নেই। শিশুরা যেমন পারছে, বয়স ৫০ কিংবা ৬০ হলেও সমস্যা নেই।’

ছড়িয়ে যাক স্বপ্ন

২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে কোটি মানুষকে নাড়া দিতে বাংলা চ্যানেলের ১৬ কিলোমিটার পাড়ি দিয়েছিলেন বেকি। সে চেষ্টা একদম বৃথা যায়নি। ধীরে ধীরে হলেও এগিয়ে যাচ্ছে নিরাপদ সাঁতার কার্যক্রম। ৭০ জন শিশু এরই মধ্যে শ্রীপুর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলেও চালু হচ্ছে একই ধরনের কার্যক্রম। বেকি স্বপ্ন দেখেন—এমন দিন আসবে, যেদিন আর একটি শিশুও পানিতে ডুবে মারা যাবে না। সে স্বপ্ন এবার সব বাংলাদেশির দেখার পালা।

বেকির ক্লাসে একদিন

মা, আমি পানিতে নামব না, ভয় লাগে—বলেই শ্রেণিকক্ষে কান্না জুড়ে দেয় প্রথম শ্রেণির ছাত্রী আশা মণি। কিন্তু মায়ের কোলে চড়ে যখন সে পুকুরপাড়ে গেল, তখন তাকে আর ফেরানোর সুযোগ ছিল না। সাঁতার শেখার দলে নাম লিখিয়েছে সে।

আশা দেখে, বন্ধুরা পানিতে বিশেষ কায়দায় হাত মেলে ফুল ফুটাচ্ছে, পানি ছুড়ে দিচ্ছে, হাত-পায়ের ঝাপটায় বুদ্‌বুদ তুলছে। তাদের সঙ্গে যোগ দিল সে-ও। এ ঘটনা ১৭ জুলাইয়ের, গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার টেংরা গ্রামে মা ও শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্র ‘শিশু পল্লী প্লাসে’। আশাসহ ওই দলের সদস্য এখন ৩০ জন। মজার ছলে শিশুদের সাঁতার শেখানোর এই বিশেষ প্রক্রিয়ার সঙ্গে আছেন ব্রিটিশ নাগরিক বেকি হর্সব্রো।

বেলা তখন ১১টা ছুঁইছুঁই। শিশু পল্লী প্লাসের ক্যাম্পাসের এক কোণে বিশাল পুকুর। সেখানে ঘাটের পাশে কালো পোশাক পরা ৬ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশুদের জটলা। তারা পুকুরে নামার অপেক্ষায়। পুকুরে বেকির বাহুতে ভর করে নানা ভঙ্গিমায় হাত-পা ঝাপটাচ্ছে এক শিশু। এই বর্ষায় এখানে এটিই তার প্রথম দিন।

কথা হয় সুইম সেফ প্রকল্পের সমন্বয়ক মামুনুর রশিদের সঙ্গে। তিনি জানালেন, বাংলাদেশে নিরাপদ সাঁতার কার্যক্রম প্রথম শুরু করে সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন রিসার্চ, বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) নামের একটি সংগঠন। এ সংগঠনের হিসাবমতে, বাংলাদেশে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ৪০টি শিশুর মৃত্যু হয় পানিতে ডুবে। বছরে মারা যায় প্রায় ১৪ হাজার। শুধু সাঁতার শেখানো গেলে এই শিশুদের জীবন বাঁচানো সম্ভব। তাই সুইম সেফ প্রকল্পের আওতায় এ প্রতিষ্ঠানে আশ্রিত শিশুদের সাঁতার শেখানো হচ্ছে। শুধু সাঁতার নয়, তাদের শেখানো হয়—কীভাবে সাঁতার না জানা পানিতে পড়ে যাওয়া শিশুকে বাঁচানো যায়। বেকি এখানে প্রশিক্ষকদের সঙ্গে পানিতে নেমে সাঁতার কাটেন। সাঁতারের
কিছু কৌশলও তিনি শিশুদের শেখান।

কথা হয় বেকি হর্সব্রোর সঙ্গে। তিনি যেন শ্রীপুরের মায়ায় পড়েছেন। বলছিলেন, ‘শ্রীপুর এলাকাটা অনেক সবুজ। খুব প্রাকৃতিক। তাই ইচ্ছে হলেই এখানে ঘুরতে চলে আসি। এবার শিশুদের সাঁতার শেখাতে এসে বেশ মজা পাচ্ছি।’