ঈদের পর দেখা হবে বলেছিল উখেংনু

উখেংনু রাখাইন
উখেংনু রাখাইন

উখেংনুর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় হলের ক্যানটিনে। ক্যাম্পাসে একেবারেই নতুন আমি। মনে তখন ভয়, কখন কী ভুল হয়ে যায়। ক্যানটিনে এক টেবিলে বসে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলাম। পানির জগটা ওর কাছে ছিল। পানির জগটা দেখিয়ে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপু, জগটা কি নিতে পারি?’ জগটা এগিয়ে দিতে দিতে ভারিক্কি গলায় বলল, ‘ফার্স্ট ইয়ার?’ থতমত খেয়ে পরিচয় দিতে যাব, মুচকি হেসে গলা নামিয়ে বলল, ‘আরে, আমিও ফার্স্ট ইয়ার।’ খাওয়া থামিয়ে দুজনে একচোট হেসে নিলাম। জানলাম, ও ফার্মেসি বিভাগের ছাত্রী।

সেই প্রথম চিনলাম মেয়েটাকে। চুল আর কপালের টিপ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। কালো টিপে বেশ মানাচ্ছিল ওকে। সব সময়ই দেখতাম টিপ পরত। বুঝে নিলাম বন্ধুর টিপ পছন্দ। তারপর দিন যত গড়াতে লাগল, উখেংনু রাখাইনের সঙ্গে বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হতে লাগল। শুধু আমার নয়, প্রীতিলতা হলের গণরুমের প্রত্যেক মেয়ের। মিশুক, আড্ডায় মাতিয়ে রাখার অসম্ভব গুণ ওর। ঘোরাঘুরিতে আগ্রহ ছিল অন্য মাত্রায়। আড্ডাপ্রিয় আর চঞ্চল উখেংনু তাই হলের গণরুমে সবার প্রিয় হয়ে উঠেছিল কদিনেই। তবে ওর নামটা কেউ ভুল করলে বেশ চটে যেত!

রাখাইন ভাষায় চমৎকার কথা বলত সে। একবিন্দু না বুঝলেও মুগ্ধ হয়ে শুনতাম আমরা। একবার বড় আপুরাসহ ফার্স্ট ইয়ারের আমরা কয়েকজন মিলে আড্ডা দিচ্ছি। এক আপু উখেংনু আর আমাকে উদ্দেশ করে বললেন আঞ্চলিক ভাষায় স্বামী নিয়ে ঝগড়া করতে! আমার বাড়ি বরিশাল, কিন্তু বরিশালের ভাষা ভালো পারি না। ও তাৎক্ষণিক একটা ভাব নিয়ে রাখাইন ভাষায় ঝগড়া করল। আমি হাঁ করে তাকিয়ে থাকলাম। পরে ওর কাছে সেসব কথার বাংলা অনুবাদ শুনে আমরা সবাই হেসেই খুন। এ জন্যই একদিন আমরা কয়েকজন খুব করে ধরে বসলাম, আমাদের রাখাইন ভাষা শেখাতেই হবে। উখেংনু কথা দিয়েছিল, শেখাবে।

বন্ধুদের সঙ্গে উখেংনু (বাঁ থেকে চতুর্থ)। ছবি: সংগৃহীত
বন্ধুদের সঙ্গে উখেংনু (বাঁ থেকে চতুর্থ)। ছবি: সংগৃহীত

দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি আমরা, কিন্তু একজন অন্যজনের দুঃখ-কষ্ট ভাগাভাগি করি। উখেংনুকে খুব কমই মন খারাপ করতে দেখতাম, হাসিমুখেই থাকত সব সময়। যে কারও প্রয়োজনে সবার আগে এগিয়ে যেত। মুখের কথায় বাঁকা হাসির চাঁদ যেন ঝুলে থাকত। প্রায়ই কক্সবাজারে ওর বাড়িতে যাওয়ার আবদার করতাম আমরা। ও বলেছিল, সবাইকে নিয়ে যাবে একদিন।

মা-বাবার একমাত্র মেয়ে উখেংনু। কক্সবাজারেই স্কুলের পাট চুকিয়েছিল। স্কুল পার করার আগ পর্যন্ত মা-বাবাকে ছেড়ে থাকেনি সে। মা তার ভীষণ প্রিয়। তারপর ঢাকার হলি ক্রস কলেজে ভর্তি হওয়ায় হোস্টেলে থাকতে হলো। মা-বাবার কাছ থেকে দূরে। মাঝেমধ্যে ভীষণ মন খারাপ হতো তার। সব সময় মা-বাবার স্পর্শ ভীষণ অনুভব করত।

ওর মধ্যে ভয়ডর কম ছিল। সত্য কথা স্পষ্টভাবে বলতে কখনো আটকাতে দেখিনি। দেশকে ভীষণ ভালোবাসত সে, ভবিষ্যতে বিদেশে যাওয়ার কথা উঠলেই সাফ জানিয়ে দিত, দেশেই থাকতে চায় সে।

গত ১৭ জুলাই ২০১৯ উখেংনুর হঠাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেদিন হাসপাতালে নেওয়ার আগেও অনেক মজা করেছিল সে। অ্যাম্বুলেন্সে করে ওকে হাসপাতালে নেওয়ার সময় সবাইকে হাসিমুখে বলেছিল, ঈদের পর দেখা হবে আবার! সবাই ওর অসুস্থতায় ভীত আমরা। রাতে জানা গেল, ওর ডেঙ্গু ধরা পড়েছে। সবার মনে ভয় দানা বাঁধল। রক্তের প্রয়োজন হলে কাকে ডাকব, মেসেঞ্জারে আমরা বন্ধুরা কথা বলে খুঁজে রাখছিলাম। তখনো বুঝিনি ১৭ তারিখের বিদায়ই শেষ বিদায় হবে ওর এই ক্যাম্পাসের সঙ্গে। এই ঈদ শেষ হবে, আরও ঈদ আসবে। হলও একদিন ছেড়ে দেব আমরা। শেষ হয়ে যাবে বিশ্ববিদ্যালয়জীবন। কিন্তু কোনো ঈদের পরই উখেংনুর সঙ্গে আর দেখা হবে না আমাদের।

লেখক: উখেংনু রাখাইনের বন্ধু, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের ছাত্রী