ফিরোজ আমাদের প্রিয়তম বন্ধু

বন্ধু ফিরোজ কবীরের (ডানে) সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত
বন্ধু ফিরোজ কবীরের (ডানে) সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত

ট্রেনে চেপে বসতেই স্মৃতিরা সব জাপটে ধরল যেন। ফিরোজ কবীর, আমরা যাকে স্বাধীন নামে জানি। আমাদের প্রিয়তম বন্ধু। আড্ডা জমিয়ে রাখা এক রসিক মানুষ। যে কিনা দেখা হলেই বলত, ‘হেই বাডি, কী অবস্থা? কোনো দিন আমাকে মুখ ফুটে বলতে হতো না কেমন আছি, আমার হাসিতেই ফিরোজ বুঝে নিত—ভালো আছি, নাকি মন্দ। কেমন করে একটা সাদামাটা জীবন কাটানো যায়, ফিরোজকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না। ফিরোজ আজ নেই, এই ধ্রুব সত্যের ভার নিয়ে আমরা ওর কাছেই যাচ্ছি।

ঢাকার কমলাপুর স্টেশন থেকে ছেড়ে আসা ট্রেনের গতি বাড়ল। স্মৃতি ঘুরছে চারপাশে। মনে হচ্ছিল বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শুরুর দিনগুলোর কথা। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের ফিন্যান্স বিভাগের ছাত্র। এখন আমরা স্নাতকোত্তর পরীক্ষার ফলপ্রত্যাশী। দুজনেই সমন্বিত ইউনিট (ঘ ইউনিট) থেকে ভর্তির সুযোগ পেয়েছিলাম। পুরো ব্যাচে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড থেকে আমরা সংখ্যায় তিনজন। আমি আর ফিরোজ ছিলাম একই সেকশনের। ঘ ইউনিট থেকে আসার কারণে প্রথম কয়েক দিন ক্লাস করতে পারিনি। তবু পরিচয়ের পর, আপনি থেকে তুমি, তুমি থেকে তুই হতে সময় লাগেনি।

রসিকতার বাক্স নিয়ে ঘুরত ফিরোজ। এত ঠান্ডা মাথায় রসিকতা করত যে অনেক সময় চিত্রনাট্য বলে মনে হতো। যারা ওর সঙ্গে একটিবার মিশেছে, তারা বলতে পারবে কী দারুণ রসিকতা ছিল তার কথায়। কাউকে কষ্ট না দেওয়া ছিল তার অনন্য বৈশিষ্ট্য। সে বিশ্বাস করত, মানুষের মধ্যে সুখ ছড়ানো যার উদ্দেশ্য, তার জন্য মানুষের সঙ্গে রাগ করা, অভিমান করা এগুলো ঠিক যায় না। প্রমাণ পেলাম ওর ব্যক্তিজীবনে। সাড়ে পাঁচ বছরে, এই বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে কারও সঙ্গেই তার শত্রুতা হয়নি। ও বরং প্রতিটা হলে ছিল সুপরিচিত। ফিরোজ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে থাকলেও সূর্য সেন হল, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল আর জহুরুল হক হলে এলে অনেকে সন্দিহান থাকত, আসলে সে কোন হলের ছাত্র। এমন হৃদ্যতা সবার সঙ্গে।

ক্যাম্পাসে আমরা প্রায়ই বিকেলে বের হতাম। আমাদের আড্ডার জায়গা ছিল বুয়েট ক্যাম্পাস। সেখানে বসেই জীবনের নানা কথা হতো। সে বলেছিল, বিসিএস অনেক সময়ের ব্যাপার, এই দীর্ঘ পথে সে হাঁটবে না। এ জন্য সে ব্যাংকার হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছিল, দ্রুত মা-বাবাকে সেবা করতে চায়।

১৭ জুলাই ২০১৯ শেষবারের মতো আড্ডা হয়েছিল আমাদের। তখনই সে বলেছিল, হজমে সমস্যা হচ্ছে আর শরীরটাও নাকি ভালো যাচ্ছে না। ১৯-২০ জুলাই তাকে ফোনে পাইনি। আমিও অন্য একটা কাজে হলের বাইরে ছিলাম। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার কথা জানতে পারি ২১ জুলাই, ওর এলাকার এক বন্ধুর কাছে। জানতে পারি, ওরা দিনাজপুর ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে আছে। ফোনে কথা হয় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে।

২২ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে আসা হয় ফিরোজকে। পুরোটা সময় হাসপাতালেই ছিলাম। এর মধ্যে জরুরি কাজে আমার ঢাকার বাইরে চলে যেতে হয়। এদিকে ওর অবস্থার অবনতি হতে থাকলে ফিরে আসি। ২৪ জুলাই কিছু পরীক্ষা করানো হয়। এদিকে দুপুরের পর আবারও পরিবারের অসুস্থ একজনকে নিয়ে আমাকে ময়মনসিংহ যেতে হয়। বিকেলে শুনি অবস্থার অবনতি হয়েছে, ঢাকা মেডিকেলের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়া হয়েছে। রক্তের প্রয়োজন হচ্ছিল, রক্ত সংগ্রহ করা হলো, অনেকের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রাখলাম।

২৫ জুলাই সন্ধ্যার দিকে স্কয়ার হাসপাতালে নেওয়া হলো। ঢাকায় ফেরার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু বের হতে হতেই ২৬ জুলাই সন্ধ্যা। বাসে উঠেই ফোনকলটা পেলাম, আমার প্রিয় বন্ধু আর নেই।

এক দিন পর ওর বাড়ির পথ ধরি। ঠাকুরগাঁও রেলস্টেশনে যখন পৌঁছালাম, তখন বেলা সাড়ে ১১টা। সেখান থেকে আরও কিছুটা পথ যেতে হলো অটোরিকশায়। আমরা ঢাকা থেকে পাঁচজন গিয়েছি। আখানগর, মহেশপুর হয়ে কালীবাড়ি—ফিরোজের গ্রাম। গ্রামের বাজারে অটোরিকশাটা থামতেই স্তব্ধ হয়ে গেলাম একটা ছবি দেখে। সমাবর্তনের সময় তোলা ফিরোজের ছবি। যে ছবির সঙ্গে যে কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে আমার। পাশেই যে আমি ছিলাম, সেই ছবিটা নিয়ে মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকেরা শোকবাণী–সংবলিত ব্যানারটা টানিয়ে রেখেছে।

অটোরিকশা থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই এলাকার লোকজন নিয়ে গেল ওদের বাড়িতে। পথেই একটা কবর নতুন বাঁশের বেড়া দেওয়া। আমি শিউরে উঠি। ভাবতে থাকলাম সদা চঞ্চল এই মানুষটা কি এখানেই বন্দী থাকবে! এটা ভাবছিলাম আর ওর স্বাধীন চলাফেরার সোনালি মুহূর্তগুলো মনে করছিলাম। হঠাৎ তাদের বাড়ির আঙিনায় পা রাখতেই আমাদের দেখে ওর বাবা আর ভাইয়ের বুকফাটা আর্তনাদ শুরু হলো। আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। তাঁদের বুকে জড়িয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। সান্ত্বনা দিতে গিয়ে আমিও মনে মনে কেঁদেছিলাম অনেক বেশি।

সেদিন রাতেই আমরা ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার রুহিয়া রেলস্টেশনে থেকে ঢাকা ফেরার ট্রেনে উঠলাম। ট্রেন চলছিল একই তালে, প্রিয়তম বন্ধুকে ফেলে আসছি আমরা। কী নির্মম সত্য!

লেখক: ফিরোজ কবীরের বন্ধু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের ছাত্র।