চা-দোকানি 'বাবু মেম্বর'

নিজের চায়ের দোকানে ইউপি সদস্য বাহারুল ইসলাম। ছবি: ছুটির দিনে
নিজের চায়ের দোকানে ইউপি সদস্য বাহারুল ইসলাম। ছবি: ছুটির দিনে

সবাই তাঁকে ডাকেন ‘বাবু মেম্বর’ বলে। পুরো নাম বাহারুল ইসলাম। বয়স ৫৩ বছর। যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার ধলগ্রাম ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য তিনি। এই জনপ্রতিনিধি পেশায় চা-বিক্রেতা। চা তৈরি ও পরিবেশনের ফাঁকে ফাঁকে দিনভর চায়ের দোকানে বসেই তিনি এলাকার মানুষের সমস্যার কথা শোনেন। ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য হিসেবে দাপ্তরিক কাজও করেন তাঁর চায়ের দোকানে বসেই।

বাহারুল ইসলামের চায়ের দোকানে কোনো কর্মচারী নেই। তিনি নিজেই চা তৈরি ও পরিবেশন করেন। চায়ের পাশাপাশি তিনি বিস্কুট, কলা, রুটি ও পান বিক্রি করেন। তবে বিড়ি-সিগারেট বিক্রি করেন না।

গত ৯ জুলাই চায়ের দোকানে বসে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। দোকানে যাঁরা আসছেন আর সামনের সড়ক দিয়ে যে গ্রামবাসী যাচ্ছেন, তাঁদের সঙ্গে তিনি কুশল বিনিময় করছেন। তাঁদের পরিবারের সদস্যরা কেমন আছেন খোঁজ নিচ্ছেন। কোনো কাগজপত্রে তাঁর সই লাগলে দোকানে বসেই করে দিচ্ছেন। মেরে দিচ্ছেন সিলমোহর।

বাঘারপাড়া উপজেলার বল্লামুখ গ্রামের বাসিন্দা বাহারুল ইসলাম। জানালেন, এই নিয়ে তিনবার তিনি ধলগ্রাম ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৯৭ সালে তিনি প্রথমবার ইউপি সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৩ সালে দ্বিতীয়বার এবং সর্বশেষ ২০১৬ সালে তৃতীয়বার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তিনি সদস্য পদে বিজয়ী হন। ছোটবেলা থেকেই সদালাপী বাহারুল ইসলাম। ভালো ফুটবলও খেলেন।

খুব ভোরে দোকান খোলেন বাহারুল। দুপুরের খাবার খেতে এক ঘণ্টার জন্য বাড়ি যান। ফিরে রাত ১০টা পর্যন্ত দোকান করেন। দোকান থেকে মাত্র ১০০ গজ দূরে ধলগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়। বৈঠক থাকলে সেখানে যান তিনি। ওই সময় দোকান বন্ধ থাকে। তিনি গড়ে প্রতি মাসে খরচ বাদে ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা আয় করেন। এ ছাড়া ইউপি সদস্য হিসেবে সরকারিভাবে ৪ হাজার ৪০০ টাকা এবং ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ৩ হাজার ৬০০ টাকা সম্মানী ভাতা পান। এতেই তাঁর সংসার চলে। তিনি দোকানে বসে অনেককে বিনা পয়সায় চা খাওয়ান।

১১ ভাইয়ের মধ্যে বাহারুল ইসলাম পঞ্চম। ১৯৮৪ সালে এসএসসি এবং ১৯৮৬ সালে এইচএসসি পাস করেন তিনি। স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন বাঘারপাড়া কলেজে। ১৯৮৮ সালে তাঁর স্নাতক (পাস) পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সংসারে অভাব। লেখাপড়া ছাড়তে বাধ্য হন তিন। চাকরি নেন ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। সেখানে ছয় বছর কাজ করে গ্রামে ফিরে আসেন। ২০১৩ সালে তিনি ধলগ্রাম বাজারে চায়ের দোকান দেন।

স্ত্রী ও এক ছেলে নিয়ে তাঁর সংসার। বাহারুল ১৯৯৮ সালে নার্গিস পারভীনকে বিয়ে করেন। তাঁদের ছেলে মিনহাজুল ইসলাম ধলগ্রাম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে পড়ছে। তাঁর জমি রয়েছে ৫৪ শতক। এর মধ্যে ১২ শতক বসতভিটা, ১২ শতক জমিতে পুকুর এবং ২৪ শতক ধানের জমি। ধানের জমির এক পাশে তাঁর ছোট চায়ের দোকান। বাহারুল ইসলাম বলেন, ‘চা বিক্রি করায় স্ত্রী ও ছেলে প্রথমে অখুশি ছিল। তাঁদের বুঝিয়েছি, কোনো কাজই ছোট নয়। এখন তাঁরা অখুশি নন।’

চা–বিক্রেতা জেনেও মানুষ তাঁকে ভোট দিয়ে ইউপি সদস্য বানিয়েছেন। ওয়ার্ডের মানুষ সব সময় তাঁকে দোকানে পান। বাহারুল বলছিলেন, ‘আমি আমার পরিবারের সদস্যদের মতোই ওয়ার্ডবাসীকে খুবই ভালোবাসি। আমিও মানুষের ভালোবাসায় মর্যাদা নিয়ে আছি। পাশাপাশি চা বিক্রি করছি। যা আমার কাছে মানুষের ভালোবাসার মতোই মর্যাদাপূর্ণ। সেখান থেকে আমার রুজি চলে। এতে আমি খুবই গর্বিত। আমার যতটুকু উপার্জন হয়, তাতেই আমার সংসার ভালোভাবে চলে যায়।’

ধলগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুভাষ দেবনাথ বললেন, ‘বাবু মেম্বর সৎ লোক। বর্তমান সময়ে তাঁর মতো মানুষ পাওয়া দুরূহ ব্যাপার। সংসার ছাড়াও হাসিমুখে একটি এলাকার ভার কাঁধে রেখেছেন। তিনি তাঁর ওয়ার্ডের মানুষের সেবা করছেন। মানুষও তাঁকে খুব পছন্দ করেন।’ 