বড়বেলায় খেলনা গাড়ির শখ

মডেল গাড়ির সংগ্রাহক কাজী আশফাক–উজ–জামানের কিছু সংগ্রহ। ছবি: সংগৃহীত
মডেল গাড়ির সংগ্রাহক কাজী আশফাক–উজ–জামানের কিছু সংগ্রহ। ছবি: সংগৃহীত

ছেলের শখ কী, এমন প্রশ্নের জবাবে কেউ যদি বলেন ‘গাড়ি জমানো’, তাহলে অনেকেই চোখ কপালে তুলতে পারেন। অবাক হওয়ার মতোই তো ব্যাপার। গাড়ি জমানো! এ তো বিরাট ব্যাপার! অসাধারণ, অভাবনীয় এক শখই বটে। কিন্তু প্রশ্নের উত্তরে কেউ যদি বলেন, ‘খেলনা গাড়ি জমানো।’ তাহলেও চোখ কপালেই উঠবে। বাচ্চাকাচ্চারা খেলনা গাড়ি কেনে বলে শোনা যায়, কিন্তু চাকরি-বাকরি করা কিংবা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়ারা যে দোকানে গিয়ে খেলনা গাড়ি কেনেন, তা দিয়ে সংগ্রহশালা বানাতে পারেন—এমনটা বিশ্বাস করবেন না অনেকেই।

কিন্তু খেলনা গাড়ি জমানো একটা শখ হতে পারে। যাঁরা এই শখ মনের গভীরে নিয়ে ঘোরেন, তাঁদের কাছে একেকটি খেলনা গাড়ি যে কী জিনিস, সেটি বলে বোঝানো সম্ভব নয়। খেলনা গাড়ি শব্দটায় তাদের আপত্তি থাকতে পারে ঘোরতর—ভাই কী বলেন! আমরা খেলনা জমাই নাকি! আমরা তো জমাই একটি নির্দিষ্ট মডেলের গাড়ির ‘মিনিয়েচার’ বা ক্ষুদ্র সংস্করণ, বাইরের দেশে যেটি অনেক পুরোনো একটি ধারণা। আমাদের দেশেও এমন কিছু ব্যাপ্তি মিলছে কিছু মানুষের হাত ধরে। তাঁরা অনেকেই চাকরি-বাকরি কিংবা ব্যবসা করেন—উপার্জনের টাকা বাঁচিয়ে সেটি ব্যয় করেন নতুন কোনো মডেলের গাড়ি কিনতে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার অবসরে হাতখরচের টাকার একটা বড় অংশ এই কাজে ব্যয় করার মানুষও কম নেই এ দলে।

‘ডাইকাস্ট কালেক্টরস অব বাংলাদেশ’—এমন শখের মানুষেরা একটি নির্দিষ্ট ব্যানারের অধীনে এসেছেন এ নাম দিয়েই, ২০১৫ সালের ২১ জানুয়ারি একটি ফেসবুক গ্রুপ হিসেবে যেটির যাত্রা শুরু হয়েছিল। জহির ইবনে মজিব এই গ্রুপের শুরুটা করেছিলেন। কিন্তু গত পাঁচ বছরে এটির সদস্যসংখ্যা যে প্রায় চার হাজার হয়ে যাবে, সেটি তিনি কখনোই ভাবেননি। ছোটবেলায় খেলনা গাড়ির শখ অনেকেরই থাকে, সেটি পরিণত বয়সের সময় কাটানোর উপাদান হয়ে যাওয়ায় দারুণ সন্তুষ্ট তিনি, ‘ছোটবেলা থেকেই শখটা ছিল। বড় হওয়ার পরও সেটি ভেতরে থেকে যাওয়ায় মাঝেমধ্যেই লজ্জা পেতাম। কেমন যেন পাগলামি মনে হতো! কিন্তু ফেসবুকেই এমন কিছু গ্রুপের খোঁজ পেলাম, যারা খেলনা গাড়ি নিয়ে রীতিমতো পাগল। এমন কিছু মানুষকে পেলাম আমাদের মধ্যেই।’

ডাইকাস্ট কালেক্টরস অব বাংলাদেশ–এর সংগ্রাহকদের কয়েকজন। ছবি: সংগৃহীত
ডাইকাস্ট কালেক্টরস অব বাংলাদেশ–এর সংগ্রাহকদের কয়েকজন। ছবি: সংগৃহীত

কাজী আশফাক-উজ-জামান মডেল গাড়ির আরেক সংগ্রাহক। গাড়ি নিয়ে আগ্রহটা মিশেছে মডেল গাড়ি জমানোর আগ্রহে। সেই ছোটবেলায় এমন একটা মডেল গাড়ি হাতে পেয়েছিলেন। শখের শুরুটা অবশ্য একটু বড় হয়েই, ‘ছোটবেলায় একটা গাড়ি হাতে এসেছিল। মিনিয়েচার জমানোর শুরুটা ২০০০ সাল থেকে।’

আশফাকের সংগ্রহে মিনিয়েচার গাড়ির সংখ্যা প্রচুর। তাঁর জীবনের একমাত্র প্যাশনও বলা চলে এটিকে। এই দুজনের মতোই ডাইকাস্ট বাংলাদেশ গ্রুপের অন্য সদস্যরাও মডেল গাড়ির সংগ্রহকে বানিয়েছেন জীবনের হাসি-আনন্দের উপকরণ। সাকিউল আহসান, দেবাশিস ভৌমিক, তারিক মাহমুদ, মোহাইমেন আদিব, শরীফুল ইসলাম, আবিরুল আবেদীন, সৌরভ তালুকদার, এস এম রিদওয়ানদের অনেকেই পাগল বলে। অবুঝেরা হাসি-তামাশার উপকরণও বানায় তাঁদের। কিন্তু এসবে তাঁদের কিছুই এসে-যায় না।

শখটি সম্পর্কে বিস্তারিত বলা প্রয়োজন। পৃথিবীর প্রতিটি ব্র্যান্ডের, প্রতিটি মডেলের গাড়িরই মিনিয়েচার সংস্করণ আছে। এগুলো কিনতে পাওয়া যায় যেকোনো খেলনার দোকানে। তবে বাংলাদেশের মিনিয়েচার গাড়ির মডেল সংগ্রাহকদের কাছে যা আছে, সেগুলো দেখলে যেকোনো মানুষেরই মাথা ঘুরে যেতে পারে। কেবল গাড়িই নয়, জহির, আশফাক, শরীফ কিংবা আবিরদের মতো সংগ্রাহকদের কাছে উড়োজাহাজ, মোটরসাইকেল, ট্রাক, বাসের মিনিয়েচারের সংখ্যাও কম নয়। অনেকে বিভিন্ন মডেলের জাহাজও সংগ্রহে রাখেন। তাঁদের কারও কাছে টাইটানিকের মিনিয়েচার সংস্করণ পাওয়া গেলে অবাক হওয়ার কোনো কারণই নেই।

ছোটবেলায় অনেকেই স্ট্যাম্প কিংবা মুদ্রা জমিয়েছেন। ডাইকাস্ট বাংলাদেশ গ্রুপের সদস্যরা গাড়ির মডেল জমান কিংবা সংগ্রহ করেন অনেকটা সেভাবেই। আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবের কেউ বিদেশে গেলে তাঁদের আরজিই থাকে কোনো বিশেষ মডেলের মিনিয়েচারের। আরেকটি কথা বলে রাখা ভালো, মিনিয়েচার গাড়িগুলো যে ধাতুতে তৈরি, সেটিকেই বলা হয় ডাইকাস্ট মেটাল।

শখের তোলা নাকি লাখ টাকা! ডাইকাস্ট বাংলাদেশের সভ্যরা এই শখের পেছনে যে পরিমাণ অর্থ ও সময় ব্যয় করেছেন, যে ত্যাগ তাঁদের স্বীকার করতে হয়েছে, তাতে এই শখের তোলা লাখ টাকাও ছাড়িয়ে অনেক দূর চলে যায়। এই শখের আড়ালে যে কিছু মানুষের মধ্যে দারুণ ভ্রাতৃত্ববোধের জন্ম দিয়েছে, সেটি কিন্তু আরও বড় ব্যাপারই।