শেওলা থেকে ন্যানোফিল্টার

পানিকে শতভাগ ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসমুক্ত করার একটি জৈব ন্যানোফিল্টার উদ্ভাবন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও বিজ্ঞানীরা। কাগজের এই ছাঁকনি তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের স্থানীয় একটি শৈবাল থেকে। লিখেছেন পল্লব মোহাইমেন
১. শেওলা থেকে ন্যানোফিল্টার উদ্ভাবনে জড়িত বিজ্ঞানী ও গবেষক (বাঁ থেকে) শারমিন জামান, খোন্দকার সিদ্দিক–ই রব্বানী, আনোয়ারা বেগম ও মোহাম্মদ আলমোজাদ্দেদী আলফেছানী । ২. উদ্ভাবিত ন্যানোফিল্টার ৩. পিথোফোরা শেওলা। ছবি: কবির হোসেন
১. শেওলা থেকে ন্যানোফিল্টার উদ্ভাবনে জড়িত বিজ্ঞানী ও গবেষক (বাঁ থেকে) শারমিন জামান, খোন্দকার সিদ্দিক–ই রব্বানী, আনোয়ারা বেগম ও মোহাম্মদ আলমোজাদ্দেদী আলফেছানী । ২. উদ্ভাবিত ন্যানোফিল্টার ৩. পিথোফোরা শেওলা। ছবি: কবির হোসেন

শৈবাল দিঘিরে বলে উচ্চ করি শির,

লিখে রেখো, এক ফোঁটা দিলেম শিশির।

(ক্ষুদ্রের দম্ভ—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

এক ফোঁটা শিশির দিঘির বিপুল জলরাশিতে অতি সামান্য অবদান রাখতে পারে, তা নিয়ে শৈবালের এমন বড়াই দম্ভোক্তিই বটে। তবে দিঘির জলকে পরিশুদ্ধ করে শৈবালই যদি সুপেয় করে তুলতে পারে? শুধু পরিশুদ্ধ নয়, একেবারে জীবাণুমুক্ত। শৈবালের গুণে দিঘি, পুকুর—এমনকি দূষিত নদীর পানি হয়ে উঠবে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসমুক্ত। কল্পকাহিনি নয়, এটি এখন বাস্তব। আর তা করে দেখিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও বিজ্ঞানীরা। আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশিত নিবন্ধে বলা হচ্ছে, এই উদ্ভাবন বাংলাদেশের লাখো মানুষকে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসমুক্ত পানি দিতে পারবে। যাতে পানিবাহিত অনেক রোগের হাত থেকে বাঁচা যাবে। যদিও সে পর্যায়ে পৌঁছাতে আরও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে।

বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছেন শেওলা থেকে ন্যানোফিল্টার বা ছাঁকনি। এর পরীক্ষা হয়েছে। তা বিফলেও যায়নি। শতভাগ উত্তীর্ণ। শেওলা থেকে তৈরি বিশেষ শৈবাল খুঁজে বের করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞানের অধ্যাপক মোহাম্মদ আলমোজাদ্দেদী আলফেছানী। বাংলাদেশের শৈবাল থেকে ফিল্টার তৈরি হয়েছে উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে। সে প্রক্রিয়ার নেতৃত্বে ছিলেন উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল বিজ্ঞান বিভাগের ন্যানোপ্রযুক্তি ও ফাংশনাল ম্যাটেরিয়ালসের অধ্যাপক আলবার্ট মিহরানিয়ান। বাংলাদেশে এই ফিল্টার প্রকল্পের সমন্বয়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল ফিজিকস অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের অনারারি প্রফেসর খোন্দকার সিদ্দিক–ই রব্বানী। ফিল্টার কাগজ তৈরি হয়ে আসার পর তার কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগে, অধ্যাপক আনোয়ারা
বেগমের নেতৃত্বে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন সেন্টার ফর অ্যাডভান্স রিসার্চ ইন সায়েন্সেসের গবেষণা বিজ্ঞানী শারমিন জামান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের পাশে শেওলা নিয়ে গবেষণা প্ল্যান্টে অধ্যাপক মোহাম্মদ আলমোজাদ্দেদী আলফেছানী। ছবি: ছুটির দিনে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের পাশে শেওলা নিয়ে গবেষণা প্ল্যান্টে অধ্যাপক মোহাম্মদ আলমোজাদ্দেদী আলফেছানী। ছবি: ছুটির দিনে

শুরুতে শেওলার খোঁজ

নতুন এই ছাঁকনির ব্যাপারে জানার জন্য আমরা বসি ঢাকার মিরপুর রোডে সিদ্দিক–ই রব্বানীর বাই–বিট কার্যালয়ে। ১৯ আগস্ট সেখানে ছিলেন আলমোজাদ্দেদীও। উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু যৌথ গবেষণার কাজ রয়েছে। সে সূত্রেই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ সিদ্দিক–ই রব্বানীর। তিনি বললেন, ‘বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য জীবাণুমুক্ত পানি দিতে শৈবাল থেকে ফিল্টার তৈরির কথা জানান আলবার্ট মিহরানিয়ান। তখন আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, আলমোজাদ্দেদী আলফেছানী দীর্ঘদিন ধরে শৈবাল নিয়ে কাজ করছেন। তিনি এ ব্যাপারে খুবই অভিজ্ঞ।’

যুক্ত হলেন আলমোজাদ্দেদী। এখানে বলে রাখা ভালো, উদ্ভিদবিজ্ঞানের এই অধ্যাপক বাংলাদেশ থেকে নতুন ১৪টি শৈবাল উপহার দিয়েছেন পৃথিবীকে। জাতীয় অধ্যাপক প্রয়াত এ কে এম নূরুল ইসলামের সঙ্গে যৌথভাবে সেগুলোর নামকরণ করেছেন। সেই নামগুলোর মধ্যে কোনো না কোনোভাবে বাংলাদেশও রয়েছে। যেমন একটা শৈবাল পেয়েছিলেন বরিশালে। সেটার নাম ‘ট্রাকিলোমোনাস বরিশালিকা’। ছাঁকনির জন্য কোন শৈবাল ভালো হবে, তার খোঁজ শুরু হলো। সেটা ২০১৮ সালের গোড়ার দিকের কথা। সিদ্দিক–ই রব্বানীর শখ ছবি তোলা। বান্দরবানের শৈলপ্রপাতের পাথরের ওপর জমা শৈবালের ছবি তুলেছিলেন। সেটা দেখালেন। আলমোজাদ্দেদী সেখানকার নমুনা শৈবাল নিয়ে এলেন গবেষণাগারে। ‘সেটা ছিল ক্যাডোফেয়া। আমি চাষ করা শুরু করলাম। কিন্তু উৎপাদনের গতি ও পরিমাণ খুবই কম।’

এরপর একই ধরনের আরেক শৈবালের কথা ভাবলেন আলমোজাদ্দেদী। তবে সেটা পিথোফোরা শৈবাল। সে কথা সুইডেনে আলবার্টকে জানালেন। ‘আলবার্ট প্রথমে বিশ্বাস করতে চাননি, যে ফিল্টারের কথা তিনি ভাবছেন, তা পিথোফোরা দিয়ে বানানো যাবে।’ তবে আলমোজাদ্দেদী যথেষ্টই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। এই শৈবাল নতুন নয়, তবে একে এ রকম কাজে আগে ব্যবহার করা হয়নি। সিলেট অঞ্চল থেকে পিথোফোরা এল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে।

‘আমরা অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, এই শেওলার গ্রোথ খুবই ভালো। তিন দিনে দ্বিগুণ হয়। মাটি, গোবর সার, পানি দিয়েই ভালো ফলন পাওয়া যায়।’ বললেন আলমোজাদ্দেদী আলফেছানী।

সিলেটি শেওলার সুইডেন যাত্রা

তখনো উপসালা পক্ষের গবেষকদের মনে সন্দেহ, এই শেওলা দিয়ে ন্যানো ফিল্টার কতটা সফল হবে। এরই মধ্যে পিথোফোরা শৈবাল পাঠানো হলো সুইডেনে। সেই পার্সেল নিয়েও কাণ্ড কম নয়। সিদ্দিক–ই রব্বানী বলেন, ‘বাতাসে পুরোপুরি শুকনা করে প্যাকেট করা হলো। ডিএইচএলকে নানা রকম মুচলেকা সই করে দিতে হলো।’

শৈবাল পাওয়ার পর ওদিকে আলবার্ট মিহরানিয়ান শুরু করলেন ফিল্টার তৈরির কাজ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের ল্যাবে ফিল্টারের কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের ল্যাবে ফিল্টারের কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয়

শেওলা থেকে ন্যানো ফিল্টার

খালি চোখে দেখা মনে হবে একরকম, অণুবীক্ষণযন্ত্রে দেখলে বোঝা যাবে আসলে কী। সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ে আলবার্ট মিহরানিয়ানের নেতৃত্ব আধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি হলো বাংলাদেশ থেকে পাঠানো শৈবাল থেকে ন্যানো ফিল্টার। খালি চোখে এক টুকরা সাদা কাগজ। সিদ্দিক–ই রব্বানী জানালেন, এই ছাঁকনিগুলোর ফুটো ১৭ ন্যানোমিটার। ফলে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস এতে আটকে যায়। বোঝার জন্য চুলের সঙ্গে তুলনা করা যায়। মানুষের একটি চুলের ব্যাস ৬০ হাজার ন্যানোমিটার। ফলে বোঝাই যায় কী পরিমাণ ক্ষুদ্র ছিদ্র রয়েছে এই ফিল্টারে। পানিবাহিত রোগজীবাণুর আকার হয় ৩০ থেকে ১০০ ন্যানোমিটার। আলমোজাদ্দেদী যোগ করলেন, ১৭ ন্যানোমিটার থেকে ক্ষুদ্র ছিদ্র হলে সেটায় আবার লবণ আটকে যাবে। ফলে পানির গুণাগুণ নষ্ট হতে পারে।

সুইডেনে প্লাস্টিকের ভাইরাস তৈরি করে সেই ছাঁকনি দিয়ে ছাঁকা হলো। ভাইরাস আটকে গেল ফিল্টারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাঠানো হলো ব্যাকটেরিয়া মানে জীবাণুমুক্ত করার পরীক্ষার জন্য। ধানমন্ডি লেক ও তুরাগ নদের পানি দিয়ে পরীক্ষা করা হলো ফিল্টার। এই পরীক্ষা নিয়ে আনোয়ারা বেগম বললেন, এই ১০০ শতাংশ ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস পানি থেকে দূর করতে পারে। পানির স্বচ্ছতাও অনেক ভালো পাওয়া যায়। এখন তো মাত্র শুরুর পর্যায়ে রয়েছে, তাই এর আরও উন্নয়ন দরকার। তবে সব থেকে বড় কথা হলো, এটা জৈব ফিল্টার।’

ব্যাপক ব্যবহারের জন্য

আনোয়ারা বেগমের কথার সুর পাওয়া গেল সিদ্দিক–ই রব্বানীর কথাতেই। ‘এখন এই ফিল্টার দিয়ে পানি ছাঁকতে প্রচুর চাপের প্রয়োজন হয়। আর সময়ও লাগে বেশ।’ সাধারণ মানুষের ব্যাপক ব্যবহারের জন্য আরও গবেষণা আরও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন প্রয়োজন, সে কথা জানালেন আলবার্ট মিহরানিয়ানও। ই–মেইলে আলবার্ট বলেছেন, ‘পিথাফোরা থেকে সম্পূর্ণ জৈব ন্যানো ফিল্টার তৈরিতে আমরা সফলতা পেয়েছি। তবে সাধারণ মানুষের কাজে লাগাতে দরকার এই ফিল্টারের ব্যাপক উৎপাদন। সে জন্য প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক বিষয় জড়িত। যদি প্রযুক্তি ও দরকারি অর্থ পাওয়া যায়, তবে আগামী তিন বছরের মধ্যে শৈবাল থেকে তৈরি এই ন্যানোফিল্টার বাজারে ছাড়া যেতে পারে। এটি ব্যবহারের জন্য সহজ যন্ত্রও তৈরি করতে হবে। গবেষণা করে পিথাফোরার ব্যাপক উৎপাদনের উপায় বের করতে হবে।

পিথোফোরা শৈবালের অাণুবীক্ষণিক ছবি
পিথোফোরা শৈবালের অাণুবীক্ষণিক ছবি

সম্ভাবনাময় শেওলা

শুধু এই ছাঁকনি নয়, পিথাফোরার আরও সম্ভাবনার কথা বললেন সিদ্দিক–ই রব্বানী ও আলমোজাদ্দেদী আলফেছানী। এটি থেকে জৈব জ্বালানি, ন্যানো কার্বন শিট, শোষণক্ষম শিট ইত্যাদি তৈরি করা সম্ভব। ন্যানো কার্বন শিট তৈরি নিয়ে বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের একটা যৌথ গবেষণাও চলছে।

এসেছে স্বীকৃতি, অপেক্ষা ব্যাপক ব্যবহারের

চলতি মাসেই পিথাফোরা শৈবাল থেকে তৈরি ন্যানোফিল্টারের সফলতা এসেছে। সফল গবেষণা হিসেবে মিলেছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও। আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির (এসিএস) সাসটেইনেবলকেমিস্ট্রিঅ্যান্ডইঞ্জিনিয়ারিংজার্নালে (ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর ৬.৯৭) ৬ আগস্ট প্রকাশিত হয়েছে এ–সংক্রান্ত গবেষণাপত্র। উপসালা বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছে বাংলাদেশের এই শৈবালের কথা। সায়েন্স ডেইলি ডটকম ১৯ আগস্ট প্রকাশ করেছে, ‘স্থানীয় শৈবাল থেকে তৈরি কাগজের ছাঁকনি বাংলাদেশে বাঁচাতে পারে লাখো মানুষের জীবন’ শিরোনামে প্রতিবেদন।

অধ্যাপক আনোয়ারা বেগমের একটি কথা এখানে উল্লেখ করা যায়, ‘ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক থাকে। তাই ভূতলের পানির (সারফেস ওয়াটার) ওপরই আমাদের ভরসা করতে হবে।’

নদী বা জলাশয়ের পানিকে পুরো বিশুদ্ধের পর পানের উপযোগী করে দিতে পারে বাংলাদেশের শেওলা থেকে তৈরি এই ন্যানো ফিল্টার। এখন শুধু দরকার একে হাতের নাগালে আনার।