সাপটা দুঃস্বপ্ন হয়ে ফিরে আসে

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

প্রায় রাতে একটা দুঃস্বপ্ন আমার ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। ধড়ফড় করে জেগে বিছানায় বসে থাকি। এরপর ঘুমাতে পারি না ঠিকমতো। ১৭ বছর ধরে একই স্বপ্ন ঘুরেফিরে আসে ঘুমের ঘোরে।

কখনো কখনো একটা সাপ জানালার গ্রিল বেয়ে নেমে আমার পা পেঁচিয়ে উঠতে থাকে, কখনো অনেক সাপ একসঙ্গে এসে ঘিরে রাখে আমাকে। মাঝেমধ্যে ঘরের সিলিংয়ে ঝুলতে থাকে। আবার কখনো শূন্যে ভেসে বেড়ায় আমার শরীরের ওপর দিয়ে। এমন স্বপ্নদৃশ্য দেখে কখনো চিৎকার করি,  কখনো কেঁদে উঠে আম্মুর কাছে চলে যাই।

ছোটবেলার ঘটনাটা আজও স্পষ্ট মনে পড়ে। ২০০২ সাল সেটা। আমি দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী। জামালপুর শহরে আমরা যে পাড়ায় থাকি, সে পাড়ায় তেমন ইটের দালান ছিল না। বেশির ভাগ বাড়িই টিনের ঘর আর বাড়ির সামনে খোলা জায়গা, কোনো বাড়ির পেছনে ঝোপঝাড়।

তবে আমাদের বাড়ির সামনে ফাঁকা জায়গা ছিল না। সে অপ্রাপ্তিটুকু পাশের বাসার সামনের খোলা জায়গা পুষিয়ে দিয়েছিল। সেই বাড়ির সামনে ছিল বিশাল খোলা জায়গা আর পেছনে একটা বাগান। স্কুল থেকে বাসায় ফিরে ব্যাগটা ছুড়ে দিয়েই দৌড় দিতাম। ভরদুপুরে নাওয়া–খাওয়া ভুলে সেই খোলা জায়গায় সমবয়সীরা খেলতাম। বাড়ি ফিরতাম আম্মুর আগমনী বার্তা পেলে। আম্মু প্রায়ই একটা চেলাকাঠ কিংবা সরু বেতের যথাযথ ব্যবহার করে আমাকে বাসায় নিয়ে যেতেন।

এ রকমই এক বিকেলে আমরা লুকোচুরি খেলছিলাম। আমি গিয়ে লুকাই বাড়ির পেছনের জংলা মতন অংশে। সেখানে বেশ বড় কয়েকটা মেহগনিগাছ ছিল। পাতা পড়ে পড়ে জায়গাটা থেকে পচা গন্ধ আসছিল। দুর্গন্ধে ওদিকটায় কেউ লুকাতে যায়নি। এই সুযোগে আমি ওখানে একটা আড়াল খুঁজে লুকিয়ে পড়ি।

খানিকক্ষণ পর দেখি একটা চকচকে, ধূসর, সবুজাভ চিকন দড়ির মতো কিছু নড়ছে। আমি তাকিয়ে  দেখার চেষ্টা করি, দেখি এবার ওটা ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি ততক্ষণে চিনতে পারি ওটা একটা সাপ।

আমার শিরদাঁড়া বেয়ে ভয়ের একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে যায়, হাঁটু কাঁপতে থাকে। আমি নড়তে ভুলে যাই। সাপটা আমার খুব কাছে চলে আসে। আমি চোখ বন্ধ করে মনে মনে দোয়া পড়তে থাকি। চোখ বন্ধ করার পর আমি আমার খালি পায়ের ওপর দিয়ে একটা ঠান্ডা প্রাণীর চলে যাওয়া অনুভব করি। সেই সঙ্গে ভাবি, আমি হয়তো সাপের কামড়ে মারা গিয়েছি। তারপর আর কিছু মনে নেই।

জ্ঞান ফিরে নিজেকে আবিষ্কার করি কতগুলো ভয়ার্ত মানুষের সামনে, বাড়িতে।

এ ঘটনার এত বছর পরও সেই দিনটাকে ভুলতে পারি না। সাপটা দুঃস্বপ্ন হয়ে বারবার ফিরে আসে।

সুমাইয়া কাফী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।