রিকশা নিয়ে কয়েক ছত্র

ফরাসি চিত্রশিল্পী গ্রাভের ক্লদ ঝিলোর চিত্রকর্ম—দুই গাড়ির সাক্ষাৎ
ফরাসি চিত্রশিল্পী গ্রাভের ক্লদ ঝিলোর চিত্রকর্ম—দুই গাড়ির সাক্ষাৎ

আমাদের অনেকেরই ধারণা, রিকশা বুঝি আমাদেরই উদ্ভাবন। বড়জোর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত এর বিস্তার। আবার কেউ কেউ মনে করেন, জাপানই রিকশার জন্ম দিয়েছে। আজ রিকশার জন্ম নিয়ে আরেকটি নতুন গল্প শোনাব। 

প্রতিদিন কোনো না কোনো প্রয়োজনেই আমাদের শরণাপন্ন হতে হয় রিকশার। ইদানীং রিকশা একেবারেই সস্তা সার্ভিস নয়। বরং রিকশায় পথ চলতে গেলে মানিব্যাগ বা পার্স থেকে বেরিয়ে যেতে পারে বড় অঙ্কের অর্থই। 

সে যাক, বলছিলাম এই অসাধারণ বাহনটির কথা। শুরুতেই স্বীকার করে নেওয়া ভালো, এই একবিংশ শতাব্দীতে যন্ত্ররাই তাদের রাজত্ব কায়েম করেছে। তাই মানুষে টানা রিকশা কেন থাকবে, এ প্রশ্ন অনেকেই করে থাকেন। এর কোনো সহজ উত্তর নেই। তবে বলা যায়, রিকশাচালকেরা এর চেয়ে ভালো কোনো কাজের সুযোগ পান না বলেই এই পেশা হয়তো আঁকড়ে ধরে আছেন। 

রিকশার চলন এশিয়ার দেশগুলোতেই বেশি। জাপানি ভাষায় এর নাম জিনরিকিসিয়া। ইউরোপের মানুষের মুখে ঘুরতে ঘুরতে তা পরিণত হয়েছে ‘রিকশা’য়। জাপানি ভাষায় তিনটি ইয়েরোগ্লিফ আছে এখানে, যার মানে ‘মানুষ; ‘শক্তি’ আর ‘বাহন’। এই তিনে মিলে হয় রিকশা। একেবারে ঠিক কথা। মানুষ তার শক্তি দিয়ে যাত্রীসমেত এই বাহনটি টেনে নিয়ে যায় বলে এর নাম রিকশা। 

কবে এই রিকশা উদ্ভাবন করল মানুষ, তা এককথায় বলা কঠিন। বলা হয়ে থাকে, ঊনবিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে (১৮৬৯ সাল) মার্কিন ব্যাপ্টিস্ট ধর্মযাজক জনাথন গোবল জাপানের ইয়াকোহোমা শহরে এসে তাঁর অসুস্থ স্ত্রীকে একটা রিকশায় বসিয়ে টানতেন। তাঁকে রিকশা টানতে দেখেই ধীরে ধীরে জাপানে রিকশা পেল জনপ্রিয়তা। 

কোনো কোনো ইউরোপীয় ইতিহাসবিদ অবশ্য বলতে পারেন, আঠারো শতকে প্যারিসে প্রথম রিকশার আবির্ভাব ঘটেছিল। সে সময়ের চিত্রকরদের আঁকা ছবিতে রিকশা আছে। যেমন, ফরাসি চিত্রশিল্পী গ্রাভের ক্লদ ঝিলোর ‘দুই গাড়ির সাক্ষাৎ’ ছবিটিতে যে বাহন দুটি দেখা যাচ্ছে, তা অবশ্যই রিকশা। এই ছবিটি ক্লদ ঝিলো আঁকেন ১৭০৭ সালে। কাগজপত্র নিয়ে যদি কথা বলতে হয়, তাহলে জাপানের তিন ব্যবসায়ীকে রিকশা তৈরির কৃতিত্ব দিতে হবে। তাঁরা হলেন কোসুকে তাকাইয়ামা, ইসুকে ইজুমি আর তাকুজিরো সুজুকি। তাঁরাই প্রথম রিকশার জন্য কাগজপত্র বের করেন। তাঁদেরই ছিল রিকশা বানানো ও বিক্রি করার লাইসেন্স। তাঁদের হাত ধরেই জাপানে ছড়িয়ে গেছে রিকশা। এবং এই পথেই তা পাড়ি দিয়েছে সীমান্ত। পৌঁছে গেছে ভারত, চীন, হংকং এবং এশিয়ার নানা দেশে। সে সময় এই বাহনটি ছিল খুবই সাশ্রয়ী এবং পাওয়া যেত হাতের নাগালে। 

বিপুলসংখ্যক দরিদ্র রিকশাওয়ালা খুবই কম পারিশ্রমিকের বিনিময়ে রিকশা চালানো শুরু করল। এতে রিকশাচালকের আর অভাব হলো না, ফলে রিকশার ভাড়াও খুব বেশি বাড়ল না। ওই চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্য রক্ষা করার মতোই ঘটনা এটি। যাঁরা ম্যারাথন দৌড়বিদ, তাঁরা এই রিকশাচালকদের ঈর্ষা করতে পারেন, কারণ তাঁরা দিনে ২৫ থেকে ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত নির্দ্বিধায় রিকশা টেনে নিয়ে যেতেন। 

রিকশাওয়ালা এত পরিশ্রম করেও খুব বেশি পয়সার মুখ দেখত না। ফলে দারিদ্র্য থেকেও রেহাই পেত না। এরা যাত্রী নিয়ে যাওয়ার পর কোনো অচেনা জায়গায় হয় কোনো সস্তা হোটেলে অথবা সেই রিকশায়ই রাস্তার ওপরে রাত কাটাত। এভাবেই কদিন কাটত, কে জানে। কিন্তু যান্ত্রিক গাড়ির আগমনে রিকশার চাহিদা আর সেভাবে থাকল না। রিকশাচালকেরা কখনোই রিকশা চালিয়ে তাদের অভাব মেটাতে পারেনি। রিকশা চালিয়ে যেটুকু টিকে থাকার সম্ভাবনা ছিল, গাড়ি আসার পর সেটাও হারাল তারা। বিংশ শতাব্দীর প্রথম ৩০ বছরে জাপানে রিকশার সংখ্যা অনেক কমে গেল। এখন তো পৃথিবীর বহু দেশেই রিকশা চালানোকে অমানবিক কাজ বলে মনে করা হয়। অনেক দেশেই মানুষ পরিবহনের জন্য রিকশাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ১৯৪৯ সাল থেকে চীনে রিকশায় মানুষ বহন করা নিষিদ্ধ। ১৯৮২ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও হাতে টানা রিকশার বিরুদ্ধে জেহাদে নেমেছিল সরকার। কয়েক দিনের মধ্যেই হাজারখানেক রিকশার জায়গা হয়েছিল গুদামঘরে। যেখানে রিকশাগুলোকে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। 

এত কিছুর পরও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রিকশা দেখা যায়। বিশেষ করে পর্যটক আসে যেসব শহরে, সেসব শহরে স্পেশাল রিকশা রয়েছে। সেটা শুধু এশিয়ায় কেন, আমেরিকা, ইউরোপের অনেক শহরেই পর্যটকদের জন্য রিকশা দৃষ্টি কাড়ে। যেসব দেশে রিকশা টানা নিষিদ্ধ, সেসব দেশের বহু জায়গায়ই নিষেধ অমান্য করে রিকশা চলে। এর বড় কারণ হলো, বেঁচে থাকার জন্য রিকশার ওপর নির্ভর করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই তাদের। 

বাংলাদেশে অবশ্য রিকশা নিষিদ্ধ নয়। ঢাকাসহ বড় বড় শহরে এখনো রিকশা একটি আরামদায়ক বাহন। মুশকিল হলো, একই রাস্তায় যখন যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক বাহন চলতে থাকে, তখন দুই ভিন্ন গতির বাহনের জন্য চলাচলে অসুবিধা হয়। ঢাকা মহানগরীতে বড় বড় ব্যস্ত রাস্তায় রিকশা চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বিভিন্ন সময় সেসব রাস্তায়ও রিকশা চলতে দেখা যায়। আমাদের বাংলাদেশে হাতে টানা রিকশা নেই। আছে সাইকেল রিকশা। এই সাইকেল রিকশা আমি দেখেছি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের সেন্ট্রাল পার্কে। যাচ্ছিলাম, জন লেননের স্মৃতিবাহী ‘ইমাজিন’ চত্বরে, যাকে ‘স্ট্রবেরি ফিল্ড’ বলা হয়। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছিল। পার্কের ভেতরেই সেই বৃষ্টির মধ্যে চলছিল রিকশা। তাতে যাত্রীও রয়েছে। দেখে ভালো লাগল। 

তথ্য: আই-ফ্যাক্ট ডটআরইউু