সুগন্ধিময় ইফতেখার

সুগন্ধি সংগ্রাহক ইফতেখার হোসেন। বিশ্বের ১০০ ব্র্যান্ডের পাঁচ শতাধিক সুগন্ধি রয়েছে তাঁর সংগ্রহে। সবচেয়ে দামি সুগন্ধির দাম প্রায় ৬০ হাজার টাকা। চলুন, পরিচিত হই এই সংগ্রাহকের সঙ্গে।

তাকজুড়ে সারি সারি সুগন্ধির বোতল। বোতলেরও রয়েছে রকমফের। কোনোটা মাঝারি, কোনোটা আবার ছোট্ট শিশি। একটি বোতল তলোয়ারের আদলে তো আরেকটি আপেলের মতো গোলাকার। বিশ্বের নানা ব্র্যান্ডের পারফিউম বা সুগন্ধির যেন সহাবস্থান! এমন বৈচিত্র্যময় সুগন্ধির সংগ্রহ কোনো দোকানে নয়। শখের বসে এগুলো সংগ্রহ করেছেন চট্টগ্রামের ইফতে খার হোসেন। কাছের মানুষের কাছে তিনি বাবুল নামেই পরিচিত। 

সুগন্ধির সঙ্গে তাঁর সখ্য কলেজজীবনে। স্বজনদের অনেকেই বিদেশে থাকেন। তাঁদের কাছ থেকে উপহার হিসেবে পেতেন সুগন্ধি। কেউ দেশে এলে তাঁরও একমাত্র বায়না থাকত একটি বোতলের। তখন থেকে ব্র্যান্ড চেনা। নানা ব্র্যান্ডের সুগন্ধির সংগ্রহের আকর্ষণ তীব্র হতে থাকে দিনে দিনে। সুগন্ধির সঙ্গে কাটাচ্ছেন প্রায় চার দশক। এখন তাঁর সংগ্রহে রয়েছে ১০০ ব্র্যান্ডের পাঁচ শর বেশি সুগন্ধি।

গত ২৫ আগস্ট দুপুরে চট্টগ্রাম নগরের মেহেদীবাগের আমিরবাগ আবাসিক এলাকার বাসায় বসে তিনি শোনান সুগন্ধি সংগ্রহের গল্প। বসার ঘরের দুটি শোকেসের তাকে তাকে সারি করে রাখা হয়েছে সুগন্ধি। আগে থেকেই নামী ব্র্যান্ডের কিছু সুগন্ধি বের করে রেখেছিলেন। এর মধ্যে ক্রিস্টেন ডিওর ব্র্যান্ডের ‘পয়জন’ সুগন্ধির বোতল মুছতে মুছতে বললেন, ‘এটি আমার সংগ্রহে থাকা দামি পারফিউমগুলোর একটি। দাম প্রায় ৬০ হাজার টাকা।’ মেরুন রঙের গোলাকার আপেলের মতো বোতলটি থেকে খানিকটা হাতে লাগিয়েও নিলেন।

এবার ইফতেখার হোসেন খোলেন স্মৃতির ঝাঁপি। সত্তরের দশকের শেষ দিকে কলেজজীবনে ব্যবহার করা ব্র্যান্ডগুলোর নামও এখনো মনে আছে তাঁর। তখন ব্যবহার করতেন পেট্রা, প্রফেসি ও ক্যাসেট। এরপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আরেক নামী ব্র্যান্ডের সঙ্গে পরিচয় হয়। সেটি এস্টি লডার। বেশ কিছুদিন ব্যবহারের পর জানতে পারেন, এই সুগন্ধি মেয়েদের।

 চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পড়া শেষ করে ১৯৮৪ সালে পাড়ি জমান মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবিতে। চাকরি পান কাতারভিত্তিক সুগন্ধি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সালাম স্টুডিও অ্যান্ড স্টোরসে। অল্প দিনেই তিনি আবুধাবির তিনটি শাখার দায়িত্ব পেয়ে যান। এবার সুগন্ধির বিশাল জগতে বিচরণ শুরু। বছর চারেক পর পরিবারও আমিরাত চলে যায়। স্ত্রী, এক মেয়ে ও দুই ছেলে নিয়ে সংসার। প্রতিদিনের কাজ শেষে প্রায় সময় কোনো না কোনো সুগন্ধি নিয়ে বাসায় আসতেন তিনি। বড় মেয়ে শিখয়োর বিনতে ইফতেখার বাবার আনা সুগন্ধি জমাতে লাগলেন। তখন তাঁর বয়স ১২ বছর। মেয়ের আগ্রহের পারদ ছড়িয়ে গেল বাবার মধ্যে। শুরু হলো সংগ্রহ। বাবা-মেয়ে মিলে গড়ে তুললেন সুগন্ধির সংগ্রহশালা। প্রতিবছরই দেশে আসার সময় সংগ্রহ করা সুগন্ধি নিয়ে আসতেন চট্টগ্রামের বাসায়। সাজিয়ে রাখেন বাসার শোকেসে।

নিজের বাড়িতে ইফতেখার সাজিয়ে রেখেছেন তাঁর সংগ্রহের সুগন্ধি। ছবি: লেখক
নিজের বাড়িতে ইফতেখার সাজিয়ে রেখেছেন তাঁর সংগ্রহের সুগন্ধি। ছবি: লেখক

তাঁর সংগ্রহের ব্র্যান্ডগুলোর অন্যতম এস্টি লডার, ল্যানকম, অ্যারামিস, ক্লিনিক, টমি, কোকো শ্যানেল, ইভ সে লোহাঁ, গেরলাঁ, রোশা, ডেভিডফ, ল্যালিক, ললিতা, কেলভিন ক্লেইন, ইউনাইটেড কালারস অব বেনেটন, সুইস আর্মি, ডানহিল, ফিফথ অ্যাভিনিউ, ডিএনজি, মনটানা, বস, লেওনার্ড প্রভৃতি।

ইফতেখার হোসেন বলে যান, সুগন্ধি হয় তিন ধরনের—কনসেনট্রেড, ইডিপি ও ইডিটি। তাঁর সংগ্রহে বেশির ভাগ কনসেনট্রেড পারফিউম। এসব অনেকক্ষণ ধরে সুবাস ছড়ায়।

বিয়ের পর মেয়ে এখন থাকে কানাডায়, তবু ইফতেখার হোসেন সংগ্রহ থামাননি। অবশ্য কিছুটা ভাটা পড়েছে। বললেন, ‘ব্যস্ততার মধ্যেও বিশেষ কোনো সুগন্ধি পেলে নিয়ে রাখেন নিজের কাছে।’

এর মধ্যে দীর্ঘদিনের চাকরিজীবন ছেড়ে আবুধাবিতে ২০১৭ সালে গড়ে তুলেছেন সুগন্ধি সরবরাহের নিজের প্রতিষ্ঠান ‘গালফ বিউটি ট্রেডিং’। ইফতেখার হোসেন আমিরাতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যেও বেশ পরিচিত নাম। ২০১৮ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতের জনক শেখ যায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ানের শততম জন্মবার্ষিকী স্মরণীয় করে রাখতে দেশটিতে বসবাসকারী ১০০ দেশের নির্বাচিত ব্যক্তিত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছে দুটি প্রতিষ্ঠান—আবুধাবি পুলিশ ও আহালিয়া গ্রুপ। বাংলাদেশি ইফতেখার হোসেন সেই নির্বাচিত ব্যক্তিত্বের একজন। বছরে দুই থেকে তিনবার দেশে আসেন। গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায়ও নানা সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত।

ফিরে আসি শখের সুগন্ধিতে। ইফতেখার হোসেন বলেন, ‘নতুন সংগ্রহ কম হলেও সব সুগন্ধি যতনে আগলে রাখি। আমার কাছে মনে হয় এসব জীবনের বড় সঞ্চয়।’