সীমান্ত নিয়ে

দড়ি বেয়েও পার হওয়া যায় পর্তুগাল–স্পেন সীমান্ত
দড়ি বেয়েও পার হওয়া যায় পর্তুগাল–স্পেন সীমান্ত

রাষ্ট্রের জন্ম হলো যখন, তখন থেকেই জন্ম হলো সীমান্তের। একদম মাপজোক করে বলা হলো, এই এলাকা আমার। এখানে ঢুকতে হলে আমার অনুমতি নিতে হবে।

অনুমতি নিয়েই যে সব সময় মানুষ কোনো দেশে আসে, তাও নয়। বিপদে পড়লে দলে দলে মানুষ অভিবাসী হয়, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও চলে আসে অন্য দেশে। এই যেমন মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ব্যাপারটা দেখুন। ওদের কেউ আমন্ত্রণ জানায়নি, তারা নিজেরাই এসেছে। ভারতের আসামে ১৯ লাখ মানুষের নাগরিকত্ব খারিজ করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, এরা বা এদের পূর্বপুরুষেরা কোনো এককালে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করেছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ হলে কিংবা স্বৈরাচারী সরকারের নিষ্পেষণেও অভিবাসী হয় মানুষ। এসব ব্যাপারে নীতিনৈতিকতা, জাতীয়তা ইত্যাদি প্রশ্নগুলো এত বেশি স্পর্শকাতর যে, এককথায় এই সীমান্ত অতিক্রম করা না-করার প্রসঙ্গে কোনো উত্তর দেওয়া যায় না।

এই বিষয়গুলোর আলোচনা হবে অন্যখানে। এখানে আমরা সীমান্ত নিয়ে কিছু চমক জাগানো আলোচনা করব।

১. বিদাসোয়া নদীটি কোথায় জানেন? ফ্রান্স আর স্পেনের সীমান্তরেখা হয়ে রয়েছে এই নদীটি। এই নদীতে রয়েছে ফাজানোভ নামে একটি ছোট্ট দ্বীপ, যার আয়তন মাত্র ০.০০৬৮২ বর্গকিলোমিটার। ১৬৫৯ সালে এই দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘ যুদ্ধের পর শান্তিচুক্তি হয়েছিল এই দ্বীপটিতেই। তখন থেকে এই দ্বীপের মালিকানা সীমান্তবর্তী দুই দেশের। বছরের ছয় মাস স্পেনের, তখন স্পেনের ইরুন শহরের দায়িত্বে থাকে দ্বীপটি। বাকি ছয় মাস দ্বীপের মালিক ফ্রান্স। তখন এর দায়িত্ব নেয় ফ্রান্সের আন্দাই শহর। এই দ্বীপ নিয়ে কোনোকালে স্পেন আর ফ্রান্স মারামারি করেনি। এর কারণ দুটো, এক. দ্বীপটা একেবারেই ছোট। দুই. এই দ্বীপে মানুষের বসবাস নেই, কী নিয়ে মারামারি হবে? আর হ্যাঁ, এখানে পর্যটকদের যাওয়ারও অনুমতি নেই।

২. এভারেস্টের চূড়ায় পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু স্থানে রয়েছে দুই দেশের সীমান্ত। এই সীমান্ত চীন ও নেপালকে আলাদা করে। এই সীমান্তে বাতাসের বেগ ঘণ্টায় ২০০ কিলোমিটার। এখানে তাপমাত্রা কখনো কখনো মাইনাস ৬০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডও হয়। ভাবুন একবার, এখানে সীমান্তরক্ষীরা কী করে টিকে থাকেন!

ফাজানোভ দ্বীপ ছয় মাস স্পেন আর ছয় মাস থাকে ফ্রান্সের অধীনে
ফাজানোভ দ্বীপ ছয় মাস স্পেন আর ছয় মাস থাকে ফ্রান্সের অধীনে

৩. বেলজিয়াম আর নেদারল্যান্ডসের মধ্যে বার্লে গ্রামটি এক আজব গ্রাম। দুই দেশের সীমান্তরেখা শুধু এই গ্রামের রাস্তাকে ভাগ করেনি, ভাগ করেছে কখনো কোনো বাড়ি বা দোকানকেও। বাড়ির এক অংশ বেলজিয়ামে, অন্য অংশ নেদারল্যান্ডসে! ভাবা যায়! মজার ব্যাপার, হল্যান্ডে রেস্তোরাঁগুলো বন্ধ হয়ে যায় তাড়াতাড়ি—এটাই নিয়ম। এ কারণে বেশি রাত পর্যন্ত রেস্তোরাঁয় কাটাতে চান যাঁরা, তাঁরা কোনো বিপদে পড়েন না। যে রেস্তোরাঁর একটা দিক বেলজিয়ামে, অন্য দিক নেদারল্যান্ডসে, সে রেস্তোরাঁর নেদারল্যান্ডসের দিককার চেয়ার–টেবিলে বসে হয়তো খাচ্ছেন আপনি, এ সময় দেখা গেল দোকান বন্ধ করার সময় হয়েছে। আপনাকে তাড়াহুড়া করে খাবার বা পানীয় শেষ করতে হবে না, শুধু একটু কষ্ট করে বেলজিয়ামের দিককার চেয়ার–টেবিলে নিজের জায়গা করে নিন। ব্যস! কোনো সমস্যা হবে না আর।

৪.  ২ হাজার বর্গমাইলের একটা জায়গা আছে মিসর আর সুদানের সীমান্তে। এই জায়গাটাকে দুই দেশের কেউই নিজের জায়গা হিসেবে স্বীকার করে না। এ জায়গার নাম বির-তাবিল, অনুবাদে যার মানে ‘লম্বা জলাধার’। নাম যা-ই হোক, এখন অবশ্য সেখানে কোনো কুয়া বা জলাধার নেই। কেন এই দুই রাষ্ট্র এলাকাটিকে নিজের সীমানার অন্তর্ভুক্ত করে না, তা কেউ জানে না। স্বাধীন এলাকার সুযোগটা কেউ কেউ নিতে চায়। সেও এক মজার ব্যাপার। এই তো ২০১৪ সালে মার্কিন নাগরিক জেরেমি হিটন এখানে এসে অবাক! আরে! কেউ এই জমির মালিক নয়! ব্যস! নিজেই তিনি মালিক বনে গেলেন। শুধু কি তাই? জেরেমি এখানে এসেছিলেন উটের পিঠে সওয়ার হয়ে, তারপর মাটিতে পুঁতেছিলেন নিজের তৈরি করা একটি পতাকা। তারপর এই ২০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে ঘোষণা করেছিলেন নিজের রাজত্ব হিসেবে। মানে এটা হয়ে গেল জেরেমির উত্তর সুদান রাজতন্ত্র। এই রাজ্যের রানি হিসেবে ঘোষণা করা হলো জেরেমির মেয়ের নাম।

মিসর ও সুদানের সীমান্ত
মিসর ও সুদানের সীমান্ত

৫. রাশিয়ার স্থলসীমান্ত এলাকা ১৪ হাজার ৫০০ কিলোমিটার। এর অর্ধেক সীমান্তই কাজাখস্তানের সঙ্গে। কাজাখস্তান হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দেশ, যে দেশের সীমান্তে কোনো সমুদ্র নেই।

৬. আমরা জানি, পৃথিবীর মানচিত্র মানে দেশের সীমান্ত বিভিন্ন সময় বদলেছে। এক দেশের কতবার ভাঙচুর হয়েছে, আবার নতুন করে গড়ে উঠেছে সীমান্ত এলাকা! আমাদের বাংলার সীমান্তটাই তো কতবার ভেঙেছে, গড়েছে। কতবার কত বিচিত্র নামে পরিচিত হয়েছে এই জনপদ। শুনলে অবাক লাগতে পারে, পর্তুগালের সীমানা কিন্তু প্রায় ৮০০ বছর ধরে স্থির হয়ে আছে। কোনো ভাঙচুর নেই তাতে। ১২৪৯ সালে সেই যে সীমান্ত রচনা করা হয়েছে, এখনো সেই সীমানা নিয়েই দেশটি আছে। আরও একটা তথ্য, পর্তুগালের পুরো স্থলসীমান্তটি রয়েছে শুধু একটি দেশের সঙ্গে, সেটি স্পেন। স্পেন আর পর্তুগালের সীমান্ত পারাপারের জন্য আছে এক অভিনব ব্যবস্থা। তারের ওপর দিয়ে যে গাড়ি চলে, মানে কেব্‌ল কার, তাতে করেই সীমান্তের ৭২০ মিটার পার হতে হয়। মাত্র ১ মিনিটে এই দূরত্ব পার হওয়া যায়, যার জন্য দিতে হয় ১৫ ইউরো। মজার ব্যাপার হলো, এই মিনিটের মধ্যেই আসলে পরিবর্তিত হয়ে যায় ঘড়ির সময়। স্পেন আর পর্তুগালের মধ্যে সময়ের ব্যবধান ১ ঘণ্টা। তাই এক দেশ থেকে আরেক দেশে গেলে সঙ্গে সঙ্গেই ঘড়ির কাঁটা পরিবর্তন করতে হয়—আগের দিকে বা পিছের দিকে।

তথ্য: আই-ফ্যাক্টডটরু