ঢাকার যানজটও হার মেনেছে যেখানে

গাড়িতে গিজগিজ করছে সড়ক। রাজধানীতে এমন যানজট নিত্যদিনের চিত্র। ছবিটি সম্প্রতি কাজী নজরুল ​ইসলাম অ্যাভিনিউ থেকে তোলা। প্রথম আলো ফাইল ছবি
গাড়িতে গিজগিজ করছে সড়ক। রাজধানীতে এমন যানজট নিত্যদিনের চিত্র। ছবিটি সম্প্রতি কাজী নজরুল ​ইসলাম অ্যাভিনিউ থেকে তোলা। প্রথম আলো ফাইল ছবি

ঢাকা শহরে বসে যখন আপনি এই লেখাটি পড়বেন, তখন ভাবতে বাধ্য হবেন, যাক, যানজটের ক্ষেত্রে ঢাকা এখনো শিশু! আমাদের এই শহরের যানজট পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ঐতিহাসিক যানজটগুলোর প্রেক্ষাপটে সত্যিই শিশু। একবার ভাবুন যে আপনি ১২ দিন ধরে যানজটে আটকে আছেন। আর আপনার পাশে অ্যাম্বুলেন্স আটকে থাকায় মারা যাচ্ছে রোগী! অথবা জন্ম নিচ্ছে শিশু। ভাবা যায়! কিন্তু সে রকম যানজটও হয়েছে পৃথিবীতে গত ৫০ বছরের ইতিহাসে। দেখুন, সেসব ঘটনা কত ভয়ংকর।

সাও পাওলোর ভয়ংকর যানজট
১০ জুন, ২০০৯
যানজট: ১৮২ মাইল

শুধু ঢাকাই নয়, পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ শহর ব্রাজিলের সাও পাওলোরও খ্যাতি আছে যানজটের কারণে। এখানেও প্রতিদিন অনেকটা সময় যাত্রীদের বসে থাকতে হয় যানজটে। তবে ২০০৯ সালের ১০ জুন এই শহরটি তার ট্রাফিক জ্যামের আগের সব রেকর্ড ভেঙে দেয়। সেদিন লোকাল ট্রেনের কর্মচারীরা ধর্মঘট ঘোষণা করায় শহরটিতে প্রায় ১৮২ মাইল বা প্রায় ২৯৫ কিলোমিটার লম্বা যানজটের সৃষ্টি হয়। এই যানজটের কারণে সাও পাওলোর বাসিন্দারা এবং গাড়ির চালকেরা একটানা চার ঘণ্টা বসে ছিলেন রাস্তায়। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয় যে, পরবর্তী সময়ে এয়ার ক্যাবস ডাকতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। এ জন্য পরে শহরটিকে ‘হেলিকপ্টার সিটিও’ নামে ডাকা শুরু হয়। তবে এখানেই শেষ নয়, ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে আবারও এই শহরে একটি দীর্ঘ যানজট বাঁধে। এই যানজট ছড়িয়ে পড়েছিল প্রায় ৩০৯ কিলোমিটার রাস্তায়।

পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির একীভূত হওয়ার যানজট
এপ্রিল, ১৯৯০
যানজট: ৪৮ কিলোমিটার

ঈদের সময় আমাদের মহাসড়কগুলোতে দীর্ঘ যানজট হওয়ার কারণ একসঙ্গে অনেক মানুষের বাড়ি ফেরার ব্যাকুলতা। তখন ৮-১০ ঘণ্টার ১৫-২০ কিলোমিটারের যানজটের ঘটনা ঘটে বিভিন্ন সড়কে। জার্মানিরও একই অবস্থা হয়েছিল। সাধারণত এ দেশে যানজটের কথা শোনা না গেলেও অন্তত একবার দেশটি মুখোমুখি হয়েছিল ইতিহাসের ভয়াবহতম যানজটের। ঘটনাটি ১৯৯০ সালের। ১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর বিখ্যাত বার্লিন দেয়ালের পতন হয় এবং পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি একীভূত হয়ে যায়। দীর্ঘদিন স্বজনবিচ্ছেদে ভোগার পর জার্মানির দুই অংশের মানুষ একে অন্যকে দেখার জন্য উদ্‌গ্রীব হয়ে ওঠেন। ১৯৯০ সালের এপ্রিল মাসে ইস্টারের চার দিনের ছুটিতে প্রায় সবাই একসঙ্গে বেরিয়ে পড়েন রাস্তায়। আর তার ফলেই ঘটে বিপত্তি। কারণ সদ্য একীভূত হওয়া জার্মানির সীমান্তে লেগে যায় প্রায় ৪৮ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট। সেদিন প্রায় পাঁচ লাখ গাড়ি ধারণক্ষমতার সড়কে নেমে আসে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ গাড়ি। এটি ছিল জার্মানির স্মরণকালের ভয়াবহ যানজট। সেদিন জার্মানির যানজটে আটকে থাকা সর্বাধিক গাড়ির ‘বিশ্ব রেকর্ড’ হয়ে যায়।

উডস্টক মিউজিক অ্যান্ড আর্টস ফেস্টিভ্যালের যাত্রাপথে যানজট, বেথেল, আগস্ট, ১৯৬৯। ছবি: সংগৃহীত
উডস্টক মিউজিক অ্যান্ড আর্টস ফেস্টিভ্যালের যাত্রাপথে যানজট, বেথেল, আগস্ট, ১৯৬৯। ছবি: সংগৃহীত

বেথেল উৎসবের যানজট 
আগস্ট, ১৯৬৯
যানজট: ৩২ কিলোমিটার

১৯৬৯ সালের আগস্ট মাস। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক এস্টেটের বেথেল শহরে আয়োজন করা হয়েছিল ‘উডস্টক মিউজিক অ্যান্ড আর্টস ফেস্টিভ্যাল’। এখানে পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত গায়ক-গায়িকাদের গান পরিবেশনের কথা ছিল। আয়োজকদের ধারণা ছিল, ৫০ হাজার থেকে ২ লাখের মতো শ্রোতা আসবে সংগীতের এই মহা-আয়োজনে। কিন্তু সবার ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করে সেই উৎসবে উপস্থিত হয় প্রায় ৫ লাখ মানুষ! এর ফলে নিউইয়র্ক এস্টেটের মহাসড়কগুলোতে তৈরি হয়েছিল ৩২ কিলোমিটার বা ২০ মাইল লম্বা এক যানজট। এই যানজট দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল ১৫ থেকে ১৮ আগস্ট পর্যন্ত। এর ফলে রাস্তায় গাড়ি রেখে নিজেদের গন্তব্যে হেঁটে হেঁটে রওনা হয়েছিল অনেক মানুষ। এ ছাড়া পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়েছিল যে, শিল্পীদের হেলিকপ্টারে করে কনসার্টের জায়গায় আনা হয়েছিল।

রাশিয়ার তুষারজট
নভেম্বর, ২০১২
যানজট: ২০২ কিলোমিটার

যানজট কতটা ভয়াবহ হলে সরকারি উদ্যোগে রাস্তার পাশে তাঁবু ফেলে চালক ও যাত্রীদের জন্য খাবার, পানি আর কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হতে পারে? এ অভিজ্ঞতা আমাদের খুব একটা নেই। কিন্তু রাশিয়ার মানুষের সে অভিজ্ঞতা আছে। এমনিতে ঠান্ডা আর তুষারঝড়ে রাশিয়ার মানুষ বেশ কাহিল থাকে। তার ওপর আবহাওয়া যদি হয় শূন্য ডিগ্রির নিচে, তাহলে তো কথাই নেই। সে রকমই ঘটেছিল ২০১২ সালের নভেম্বর মাসের শেষের দিকে। তখন উষ্ণতা শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেছে। রাশিয়ায় শুরু হয়েছে প্রবল তুষারপাত। এ অবস্থায় সেন্ট পিটার্সবার্গ ও মস্কোর মধ্যবর্তী এম-টেন মহাসড়কে লেগে যায় প্রায় ২০২ কিলোমিটার লম্বা এক বিশাল যানজট। প্রবল তুষারপাতের ভেতর প্রায় ১২৫ মাইল মহাসড়কজুড়ে টানা তিন দিন হাজার হাজার মানুষ আটকে পড়ে। আটকে পড়ে ৪০ হাজারের মতো ট্রাক। শুক্রবার শুরু হওয়া এই যানজট রোববার পর্যন্ত বহাল ছিল। অবস্থা এতই বেগতিক হয়ে গিয়েছিল যে, সরকার রাস্তার পাশে তাঁবু খাটিয়ে আটকে পড়া চালক এবং যাত্রীদের খাবার ও পানির ব্যবস্থা করতে বাধ্য হয়েছিল। এমনকি মানসিকভাবে পরিশ্রান্ত মানুষকে, বিশেষ করে ট্রাকচালকদের জন্য করা হয়েছিল বিশেষ কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা।

বেইজিংয়ে ১২ দিনের যানজটের ১ দিন, আগস্ট, ২০১০। ছবি: এএফপি
বেইজিংয়ে ১২ দিনের যানজটের ১ দিন, আগস্ট, ২০১০। ছবি: এএফপি

বেইজিংয়ের ১২ দিনের যানজট
আগস্ট, ২০১০
যানজট: ১০০ কিলোমিটার

ঢাকা শহরের বর্তমান যানজটের কারণ কী? মেট্রোরেলের নির্মাণ, রাস্তা সংস্কার এবং এসব উন্নয়নকাজের জন্য ব্যবহার করা বিশাল আকৃতির লরির চলাচল। তাই তো? ঠিক একই কারণে চীনেও একবার যানজট হয়েছিল। সেই যানজট ছিল একটানা ১২ দিন! এটি এখন পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলা যানজট।

শোনা যায়, এই দীর্ঘ যানজটে একই সঙ্গে জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে-চুরি-ছিনতাই-খুন সবই হয়েছিল! অ্যাম্বুলেন্স আটকে রোগীর মৃত্যু যেমন হয়েছিল, তেমনি জন্ম নিয়েছিল অনেক শিশু। বিয়ের গাড়ি আটকে কয়েকটি জুটির বিয়েও হয়েছিল এই যানজটে। তা ছাড়া স্থানীয় মানুষজন চালক ও যাত্রীদের অসহায়ত্বের সুযোগে চুরি, ছিনতাই এবং খুনের ঘটনাও ঘটিয়েছিল বলে শোনা যায়। ঘটনাটি ২০১০ সালের আগস্ট মাসের।

২০১০ সালের আগস্ট মাসে চীনের বেইজিংয়ে এই ভয়াবহ যানজটের শিকার হয়েছিল বেইজিংবাসী। প্রায় ১০০ কিলোমিটার বা ৬২ মাইল দীর্ঘ এই যানজটে লাখ লাখ মানুষ আটকে ছিল প্রায় ১২ দিন ধরে। ১৪ আগস্ট শুরু হওয়া এই ঐতিহাসিক যানজটে চীনের প্রধান প্রধান কিছু মহাসড়ক পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এই সড়কগুলোর মধ্যে ছিল বেইজিং ও তিব্বত সংযোগকারী একটি এক্সপ্রেসওয়ে। সে সময় এমনও হয়েছে যে, একজন চালক সারা দিনে মাত্র ১ কিলোমিটার এগিয়ে যেতে পেরেছেন। আবার কেউ কেউ পাঁচ দিন ধরে স্থির ছিলেন এক জায়গাতেই। মূলত এই যানজট শুরু হয় একসঙ্গে কয়েকটি সড়কের সংস্কারকাজ হাতে নেওয়ার কারণে। এতে মহাসড়কগুলোর সক্ষমতা প্রায় ৫০ শতাংশ নেমে আসে। এ ছাড়া সড়ক সংস্কারের কাজে মালবাহী ট্রাকের আনাগোনা তো ছিলই। স্থানীয় অধিবাসী এই বিখ্যাত ট্রাফিক জ্যামের পুরো ফায়দা তুলে নেয়। তারা খাবার ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস প্রায় ১০ গুণ চড়া দামে বিক্রি করে। শুরু হয়েছিল চুরি, ছিনতাই। ট্রাকচালকেরা তেলের ট্যাংক ধরে ঘুমাতে শুরু করেন, যাতে সেটা চুরি না যায়।

যানজট নিয়ে ঢাকাবাসীকে কিছু বলা সত্যি কঠিন। কিন্তু এটাও অস্বীকার করা যায় না যে, যানজটের কোনো কোনো অভিজ্ঞতা আমাদের এখনো হয়নি। হোক সেটা আমরা চাই না।