দিদিমণির দুই টাকা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

পড়াশোনায় যে একেবারেই অমনোযোগী হয়ে পড়েছি, সে আমি নিজেও বুঝতে পারছিলাম। বড় হলে হয়তো অনেকে বলত—ছেলেটা একেবারে বাউণ্ডুলে স্বভাবের!

তখন আমি চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি। নিচের ক্লাসগুলো টেনেটুনে উতরে এটুকু এসেছি। আমার পড়াশোনা নিয়ে মা-বাবা ভীষণ চিন্তিত। এদিকে আমার স্কুলে যেতেই মন চাইত না। কোনো দিন মায়ের চাপাচাপিতে যদিও স্কুলে গিয়েছি, সেদিন ক্লাস না করে খেলাধুলাতেই মশগুল থাকতাম। এমনও হয়েছে, বাড়ি থেকে স্কুলে যাওয়ার নাম করে বেরিয়ে স্কুলের পেছনে গিয়ে পালিয়ে থেকেছি। যখন স্কুল ছুটি হয়েছে, ব্যাগ কাঁধে সবার সঙ্গে বাড়ি ফিরেছি। স্কুলের গণ্ডির ভেতর কোনো বিপদ (কোনো স্যারের দেখে ফেলার শঙ্কা) হতে পারে ভেবে কোনো দিন স্কুলে না গিয়েই বাড়ি ফিরে এসে বলতাম স্কুল ছুটির কথা। মা যখন সত্যি ঘটনা জানতে পেতেন, তখন পিঠে রীতিমতো বস্তা বাঁধতে হতো।

এমনই উচ্ছন্নে যাওয়ার দিনগুলোতে স্কুলে এলেন একজন শিক্ষক। অন্য ম্যাডামদের মতো তাঁকেও আমরা ‘দিদিমণি’ ডাকি। নতুন দিদিমণিকে কেন যেন অন্য রকম মনে হলো। আমাদের স্কুলবিমুখ দলটাকে খুব ভালোবাসেন, আদর করেন। এদিকে মা আমার সব ধরনের অপকর্মের কথা দিদিমণির কাছে বলে এসেছেন শুনলাম। তারপরও তিনি আমাকে শাসন করলেন না। বরং আমার মতো দুষ্টুকে দিদিমণি স্নেহ করতে লাগলেন। প্রতিদিন আমার হাতে দুই টাকা করে দেন।

দিদিমণির ভালোবাসা আর দুই টাকার জন্য আমি প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া শুরু করলাম। আগের থেকে পড়াশোনায় মনোযোগ বাড়ল। কিছুদিনের মধ্যেই আমি দিদিমণির প্রিয় ছাত্র হয়ে উঠলাম। চতুর্থ শ্রেণির দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় ভালো ফল করলাম। মা-বাবা অবাক হলেন।

এতই খুশি হলেন যে দিদিমণির এই স্নেহ ও ভালোবাসার কথা জানতে পেরে আমাকে দেওয়া টাকাগুলো ফেরত দিতে গেলেন মা। কিন্তু দিদিমণি নেননি।

সেই থেকে আমার জীবনের মোড় ঘুরে গেল। বার্ষিক পরীক্ষাতেও প্রথম হলাম। আনন্দে দিদিমণি আমাকে তাঁতিদের বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে গেলেন। পড়াশোনায় আরও মনোযোগী হলাম।

দিদিমণিকে পেলাম উদার মনের মানুষ হিসেবে। একজন শিক্ষকের মধ্যে যতগুলো গুণ থাকা দরকার, তার প্রায় সব দিদিমণির মধ্যে ছিল। তিনি আমাদের মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করতেন। কোনো ভুল হলে বুঝিয়ে বলতেন। ভালো কাজের প্রশংসা করতেন। সব সময় প্রাণবন্ত থাকতেন, হাসিখুশি থাকতেন। অফুরন্ত প্রাণশক্তিপূর্ণ একজন মানুষ ছিলেন।

ছোটবেলায় তাঁকে দেখে আমিও তাঁর মতো শিক্ষক হতে চেয়েছিলাম। এখন সময় বদলেছে, পড়ালেখার ধরন বদলেছে কিন্তু শিক্ষকের নীতি-আদর্শ ও গুণ সব সময় একই ছিল, আছে এবং থাকবে। উচ্চশিক্ষার জন্য  গ্রাম থেকে শহরে আসতে হয়েছিল। সদ্য পড়াশোনা শেষ করেছি। আমিও শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখি। দিদিমণির মতো একজন মানুষ হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি।

দিদিমণি এখন অবসর জীবনযাপন করছেন। এখন মাঝেমধ্যে যখন শহর থেকে গ্রামে বেড়াতে যাই, তখন স্কুলটার সামনে এলেই দিদিমণির কথা মনে পড়ে। এখনো স্কুলের বারান্দায় তাঁকে খুঁজে ফিরি। দিদিমণি হয়তো এখন আমাকে আর চিনতে পারবেন না। কিন্তু ঠিকই তিনি আমার আদর্শ হয়ে আছেন। তাঁর স্নেহ, ভালোবাসা, আদর আমাকে বদলে দিয়েছিল। এমন মায়ের মতো দিদিমণি থাকলে আমি আজীবন ছাত্র হয়ে থাকতাম

ঢাকা