সাইকেলের ডানা

ক্লাস ফোরে পড়ার সময় রাশেদ হঠাৎ একটা সাইকেল কিনে ফেলল। সাইকেলে টুং টুং শব্দ তুলে সে গর্বিত ভঙ্গিতে স্কুলে আসে। রাশেদ ক্লাসে ভালো ছাত্র হিসেবে পরিচিত নয়, কেউ দাম দেয় না। কিন্তু সাইকেল কেনার পর তার জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া হয়ে গেল। আমি বাসায় ফিরে ঘোষণা দিলাম—সাইকেল না হলে আর স্কুলে যাব না। এটা প্রেস্টিজের ব্যাপার। স্কুলে সবার সাইকেল আছে। তারা সাইকেলে করে হেলতে–দুলতে স্কুলে আসে (সবার সাইকেল আছে ব্যাপারটা যদিও সত্য নয়। তবে এটা বলে আমার কোনো অনুশোচনা হলো না)। 

বাসা থেকে জানানো হলো, যদি বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম হতে পারি তবেই সাইকেল কিনে দেওয়া হবে। আমি মন খারাপের একটি ভাব নিয়ে বাড়িময় ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। যাকেই দেখি সাইকেলবিষয়ক একটি গল্প বলে এর গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করি। মা একদিন ধরে দিলেন কঠিন মার। আমি অনশন করলাম, খাওয়াদাওয়া বন্ধ। বিষয়টা হালকাভাবে নেওয়ার কিছু নেই। 

বাবা আমাকে ডেকে বললেন, ‘শুনলাম, তুই নাকি কিছু খাবি না?’ 

আমি গম্ভীর গলায় বললাম, ‘হু’। 

 ‘এতে লাভ?’ 

আমি চুপ করে রইলাম। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলাম। 

বাবা বললেন, ‘তোর একটা সাইকেলের খুব শখ?’ 

 ‘হু। কালো সাইকেল।’ 

 ‘আচ্ছা যা কিনে দেব।’ 

বাবার একটা সাইকেল ছিল। বাবা বললেন, চল আজ তোকে সাইকেলে করে ঢাকা শহর ঘুরিয়ে আনি। আমি সাইকেলে চড়লাম। সাইকেল চলতে শুরু করল। বাবা গতি বাড়াতে লাগলেন। একসময় আমার ভয় ভয় লাগতে শুরু করল। শাঁই শাঁই করে পাশ দিয়ে বড় বড় গাড়ি যাচ্ছে। আমি বললাম, ‘বাবা, আস্তে চালাও, ভয় লাগে’। 

বাবা বললেন, ‘তাই নাকি? তুই তো দেখি ভিতু! শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরে থাক।’ 

সাইকেল চলছে। কেমন ঢেউয়ের মতো একটা রেশ হচ্ছে শরীরে। একসময় ভয়টা ভুলে গেলাম। চলতে চলতে হঠাৎ বাবা সাইকেল থামালেন। আমি ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে গেলাম। বাবা হাত বাড়িয়ে আমাকে তাড়াতাড়ি ধরে ফেললেন। 

 ‘ভয় পেয়েছিস?’ 

 ‘হু।’ 

 ‘ভয়ের কিছুই নেই। লালবাতি জ্বললে থামতে হয়। সব গাড়ি থেমেছে, আমরাও থামলাম। হঠাৎ থেমেছি বলে ধাক্কার মতো লেগেছে।’ 

 ‘লালবাতি কেন জ্বলে?’ 

 ‘এটা সিগনাল। থামার সিগনাল। জীবনটাও একটা সাইকেলের মতো। হেলেদুলে চলতে চলতে এটাও একসময় থামবে। সামান্য ঝাঁকিতে ভয় পেয়ে গেলে তো হবে না। আজ আমি তোকে ধরে ফেললাম। একদিন আমি থাকব না, সেদিন তোকে ধরে ফেলার কেউ থাকবে না। কাজেই ভয় পাওয়া যাবে না।’ 

বাবার কথাগুলো আমার কাছে কঠিন মনে হলো। তাঁর কথা বুঝে কাজ নেই, পরদিনই আমাকে একটা কালো সাইকেল কিনে দিলেন বাবা। মা বাবাকে বললেন, ‘ছেলেকে নষ্ট করার মূল কারিগর হলে তুমি।’ বাবা হেসে বললেন, ‘এই ছেলের পেছনে তোমারও অবদান আছে। কাজেই অর্ধেক কারিগর তুমি। নাকি ভুল বললাম?’ 

পরদিন বাবা আমাকে কীভাবে সাইকেল চালাতে হবে বুঝিয়ে দিলেন। আমি অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সাইকেল চালানো শিখে ফেললাম। আরও কিছু দিন যেতেই লক্ষ করলাম, চোখ বন্ধ করেও সাইকেল চালাতে পারি। আমার সাইকেলটা রাশেদের সাইকেলের চেয়েও সুন্দর। 

এরপর কতটা বছর কেটে গেল। একদিন জীবনের সিগনালে বাবা থেমে গেলেন চিরতরে। বারান্দায় পড়ে রইল তাঁর মলিন সাইকেল। আমার সাইকেলটা তখনো চকচকে। শেষ হলো একটা গল্পের। হায়রে সোনালি শৈশব! দুই চাকার সাইকেল জীবনে অসংখ্যবার চালিয়েছি। হঠাৎ থামাতে গিয়ে বেশ কয়েকবার পড়েও গেছি। আমাকে আর কেউ ওঠানোর ছিল না। প্রতিবার পড়ে যাওয়ার সময় মনে হয়েছে, অদেখা এক জগৎ থেকে বাবা বলছেন, খোকা ভয় পাওয়া চলবে না কিন্তু। সাইকেলটা নিয়ে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়া। এটাই জীবন। 

জন রাসেল

ঢাকা।