জেলখানাহীন মেঘের দেশ আন্দরা

আন্দরার মানচিত্র ও জাতীয় পতাকা। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস
আন্দরার মানচিত্র ও জাতীয় পতাকা। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

ইউরোপের দক্ষিণ-পশ্চিমে ফ্রান্স এবং স্পেনের সীমান্তে পিরিনিজ পর্বতমালার ঢাল ঘেঁষে মেঘের কোল ছুঁয়ে ছবির চেয়ে সুন্দর খুবই ছোট্ট একটি দেশ আছে, দেশটির নাম আন্দরা, পুরো নাম প্রিন্সিপালিটি অব আন্দরা। অনেকে মনে করেন যে ‘আন্দরা’ আরবি ‘আল-দুরা’ থেকে উদ্ভূত হতে পারে যার অর্থ, ‘মুক্তা’। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ১,০২৩ মিটার (৩,৩৫৬ ফুট) উঁচুতে ইউরোপের সর্বোচ্চ শহর আন্দরা-লা-ভেইয়া হচ্ছে আন্দরার রাজধানী।

ঝকঝকে শপিং মলে ক্রেতাদের ভিড় কম নয়। কারণ কেনাকাটার জন্য কোনো কর দিতে হয় না অর্থাৎ পুরোটাই ডিউটি ফ্রি। সে জন্য সিগারেট, কঠিন পানীয়, সুগন্ধি আর ইলেকট্রনিকসের রমরমা ব্যবসা। চিনি, মাখনও বেশ সস্তা।

মানচিত্রে এ দেশটি খুঁজতে গেলে খুব মনোযোগী হতে হবে। কারণ এ দেশটি আয়তনে মাত্র ৪৬৮ বর্গ কিলোমিটার। অর্থাৎ আমাদের বাংলাদেশ আন্দরা চেয়ে ৩০৮ গুণ বড়। এ দেশটির সবচেয়ে দীর্ঘ রাস্তাটি মাত্র ৪০ কিলোমিটার। আর জনসংখ্যা ৭৩ হাজারের একটু কম। অথচ প্রতি বছর এক কোটি পর্যটক এ দেশে আসেন। ভ্যাটিকান সিটির কথা মাথায় রেখে মাথা পিছু পর্যটকদের সংখ্যায় টেক্কা দেবে এমন আরেকটি দেশ পাওয়া যাবে, বলা ঠিক হবে না। ক্ষুদ্রতার দিক দিয়ে আয়তনে পৃথিবীতে এ দেশটি ১৬তম আর লোকসংখ্যায় ১১ নম্বর আসনে।

২০০৪ সালে ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ-এর তালিকায় স্থান করে নেয় আন্দোরার স্বর্গ সদৃশ ল্যান্ডস্কেপ। ছবি: লেখক
২০০৪ সালে ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ-এর তালিকায় স্থান করে নেয় আন্দোরার স্বর্গ সদৃশ ল্যান্ডস্কেপ। ছবি: লেখক

২,৯৪২ মিটার (৯,৬৫২ ফুট) উচ্চ কোমা পেদ্রোসা আন্দরার সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ। অতিরিক্ত উচ্চতার কারণে, দেশের উপত্যকাগুলোতে বছরের বেশ কয়েক মাস ধরে পুরোপুরি তুষারপাত হয়। পর্বতমালা আর উপত্যকা বেয়ে নেমে এসেছে ছোট ছোট বহু ঝরনাধারা। এসব ঝরনাধারা একত্রে মিলে সৃষ্টি হয়েছে ভ্যালিরা নদী। অন্যদিকে মাদ্রিউ, পেরফিতা এবং ক্লেরার মিলে প্রবাহিত হয়েছে আরেকটি খরস্রোতা পাহাড়ি নদী। আন্দরার স্থলভাগের প্রায় দশমাংশ দখল করে আছে অপ্রশস্ত বরফগলা জলের এমন নদীগুলো। বরফ শুভ্র প্রকৃতি, খাঁড়া উপত্যকা এবং খোলা বিস্তীর্ণ চারণভূমির সমাহারে এ দেশের ভূ-প্রকৃতি অত্যন্ত সুন্দর। আর তাই ২০০৪ সালে ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ-এর তালিকায় স্থান করে নেয় আন্দরার স্বর্গ সদৃশ ল্যান্ডস্কেপ।

রাজধানী আন্দরা-লা-ভেইয়া ছাড়িয়ে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে তীব্র স্রোতস্বিনী পাহাড়ি নদী গ্রান ভ্যালিরার তীরে সান্তা কলোম গ্রামে এ উপত্যকার প্রথম বাসিন্দাদের ব্যবহৃত পাথর চেঁচে তৈরি ধারালো ছুরি, বর্শা, ইত্যাদি পাওয়া যায়। ভিলা ও অরডিনো-তে রয়ে গেছে প্রাচীন যুগের স্মৃতি চিহ্ন। গবেষকেরা মনে করেন, প্রথম বসতি স্থাপনের সে সময়টা ছিল নিওলিথিক অর্থাৎ নতুন প্রস্তর যুগে, যা এখন থেকে প্রায় ১৩ হাজার বছর আগে। এর অনেক বছর পর, প্রথম চার্লস ৮০৩ সালে এই অঞ্চলটি মুসলমানদের কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করেন এবং তিনি তাঁর পুত্র প্রথম লুই-এর ওপর এ দেশের দায়িত্ব অর্পণ করলে তিনি আন্দরার অধিবাসীদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেন। পরবর্তীতে প্রথম চার্লসের পৌত্র দ্বিতীয় চার্লস স্পেনের উর্গেল অঞ্চলের ভূস্বামীর হাতে এ দেশের শাসনভার ন্যস্ত করেন।

আন্দোরার অর্থনীতি প্রায় পুরোটাই পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল। ছবি: লেখক
আন্দোরার অর্থনীতি প্রায় পুরোটাই পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল। ছবি: লেখক

বর্তমানে আন্দরা হচ্ছে পৃথিবীতে একমাত্র সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশ, যে দেশে একই সঙ্গে দু জন রাষ্ট্রপ্রধান। একজন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট আর অন্যজন হচ্ছেন স্পেনের উর্গেল অঞ্চলের বিশপ। ১৯৯৩ সালের আগে পর্যন্ত এ দেশে সামন্ততান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বলবৎ ছিল। ১৪ মার্চ ১৯৯৩ সালে আন্দরার সংবিধান রচনা ও স্বাক্ষরিত হয়। সেই থেকে দেশটি আইনের শাসনের অধীনে একটি গণতান্ত্রিক সামাজিক রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পায় এবং সে বছরই জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ করে। অন্যান্য অনেক দেশের সঙ্গে এদের হৃদ্যতাপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে এবং ১৯৯৪ সাল থেকে ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের সদস্য পদ পায় দেশটি।

১৯৯৩ সালে গণভোটের মাধ্যমে আন্দরার শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর পরিবর্তন ঘটিয়ে জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়। প্রতি চার বছর পর পর জনগণের ভোটে সরাসরি সাধারণ পরিষদের সদস্যরা নির্বাচিত হন। এই সাধারণ পরিষদের সদস্যদের এক অর্থে এদের জাতীয় সংসদের সাংসদ বলা চলে। এদের সংখ্যা সাকল্যে ২৮ জন। ১১ সদস্য নিয়ে মন্ত্রী পরিষদ গঠিত হয়। এ বছর মে মাসের ১৬ তারিখ থেকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন চল্লিশ বছর বয়স্ক জ্যাভিয়ে এসপো জামোরো। আন্দরার বয়স প্রায় ১ হাজার বছর হলেও যুদ্ধ-বিগ্রহে জড়ানোর কোনো রক্তাক্ত ইতিহাস নেই। আন্দরাকে অপরাধমুক্ত দেশ বলা চলে। এ দেশে কোনো জেলখানা নেই। একান্ত প্রয়োজন হলে, ফ্রান্স কিংবা স্পেনের জেলখানা ব্যবহার করা হয়।

নদীর নাম ভ্যালিরা। ছবি: লেখক
নদীর নাম ভ্যালিরা। ছবি: লেখক

পৃথিবীতে আন্দরাই একমাত্র দেশ যে দেশের দাপ্তরিক ভাষা হচ্ছে কাতালান। তবে প্রায় সবাই স্প্যানিশ ও ফরাসি ভাষা জানে। এ দেশে ১৬ বছর পর্যন্ত লেখাপড়া বাধ্যতামূলক। স্কুল নির্মাণ ও দেখাশোনার ভার সরকারের। তবে শিক্ষকদের বেতন দেয় ফরাসি ও স্পেন সরকার। এখানকার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৭ সালে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন পড়াশোনা করছে প্রায় ৫০০ ছাত্র, ছাত্রী। আন্দরার শিক্ষিতের হার শত ভাগ। আন্দরার নিজস্ব কোনো ব্যাংক বা মুদ্রা ছিল না। বর্তমানে এখানে লেনদেনের মুদ্রা হিসেবে ইউরো প্রচলিত আছে। তবে ৩০ জুন ২০১১ সাল থেকে নিজেদের দেশের ছাপসহ ইউরো মুদ্রা প্রচলন করা হয়েছে।

রাজধানী আন্দরা-লা-ভেইয়ার রাস্তার পশে একটি বাড়ির দেয়াল। জেরানিয়াম ফুল ছবির মতো সুন্দর শহরটির সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। ছবি: লেখক
রাজধানী আন্দরা-লা-ভেইয়ার রাস্তার পশে একটি বাড়ির দেয়াল। জেরানিয়াম ফুল ছবির মতো সুন্দর শহরটির সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। ছবি: লেখক

আন্দরার অর্থনীতি প্রায় পুরোটাই পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল। জনসংখ্যার প্রতি দশজনের নয়জনই শহরে বাস করেন। এখানকার প্রধান কৃষিজাত পণ্য হচ্ছে তামাক। সঙ্গে আছে মেষ পালন। এদের মাথাপিছু আয় চুয়াল্লিশ হাজার মার্কিন ডলারের ওপরে। এ দেশে কাউকে কোনো আয়কর দিতে হয় না। দেশের সামরিক বাজেট স্বেচ্ছাসেবী অনুদানের ওপর নির্ভর করে। আন্দরা নামের এই দেশটি ছোট হলেও ১৯৭৬ সাল থেকে নিয়মিত অলিম্পিক গেমসে সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা, অ্যাথলেটিকস, শুটিং এবং জুডোর মতো ইভেন্টে অংশ নিচ্ছে। যদিও আজ পর্যন্ত কোনো পদক জয় করতে পারেনি।

আন্দরায় তিনটি প্রাকৃতিক উদ্যান রয়েছে, যেখানে সুরক্ষিত আছে বহু প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদ। এক ধরনের ছয় পাপড়ির সাদা ডেফোডিল ফুল এদের জাতীয় ফুল। পূর্বে এ দেশটি ছয়টি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত ছিল, বর্তমানে সাতটি অঞ্চলে বিভক্ত। এদের পতাকার রং তিনটি: নীল, হলুদ ও লাল। জাতীয় নীতিকথা হলো, ‘একতাবদ্ধ নৈতিকতা সব শক্তির ওপরে।’

জেলখানা না থাকলেও আন্দরা নামের ছোট্ট দেশটিতে আছে ২০০ টির বেশি হোটেল। ছবি: লেখক
জেলখানা না থাকলেও আন্দরা নামের ছোট্ট দেশটিতে আছে ২০০ টির বেশি হোটেল। ছবি: লেখক

ঢাকায় আন্দরার দূতাবাস নেই। ভিসার জন্য ফরাসি অথবা স্পেন দূতাবাসে যোগাযোগ করতে হবে। আর আপনার যদি ফ্রান্স অথবা স্পেনের ভিসা থাকে তবে সে ভিসা দিয়ে আপনি ৯০ দিনের জন্য সে দেশে অবস্থান করতে পারেন, এ জন্য আপনার বাড়তি কিছু করণীয় নেই। ফ্রান্স কিংবা স্পেন, যে দেশ থেকেই আসুন না কেন, আপনাকে পাহাড় বেয়ে সর্পিল পথে উঠে যেতে হবে। এ দেশে কোনো বিমান বন্দর নেই, নেই রেলপথ। গরমে বেড়াতে গেলেও সঙ্গে গরম কাপড় রাখা ভালো। কারণ হঠাৎ করে তাপমাত্রা নেমে যেতে পারে যেকোনো সময়। তা ছাড়া রাস্তায় মেঘের সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে—মেঘের দেশের দেশ বলে কথা।

লেখক: ফরাসি বিচার বিভাগে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত