বিশ্বসেরা পাঁচ গ্রাফিতিশিল্পী

১. ব্যাঙ্কসি

দেশ: ইংল্যান্ড, জন্ম: ১৯৭৪

গ্রাফিতিশিল্পীদের মধ্যে কিংবদন্তি হয়ে উঠেছেন ব্যাঙ্কসি। দুনিয়ার অন্যতম রহস্যমানব হিসেবেও তাঁকে চেনে সবাই। এখনো কেউ জানে না, কে এই লোক, ঠিক কোথায় তাঁর বাস। বিভিন্ন সময় অনেককে ব্যাঙ্কসি বলে ধারণা করা হলেও অকাট্য প্রমাণের অভাবে ধোঁয়াশা আরও ঘন হয়েছে। ব্যাঙ্কসির সুতীক্ষ্ণ-সরস সব গ্রাফিতি আর সিনেম্যাটিক রহস্যের কারণে মানুষের আগ্রহের পারদ ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। তাঁর আঁকা প্রথম নজর কাড়ে ১৯৯০ সালের দিকে, যুক্তরাজ্যের ব্রিস্টলে। ‘ম্যাসিভ অ্যাটাক’ নামের এক ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য রবার্ট ডেল নাজাও একই এলাকার বাসিন্দা বলে গুঞ্জন ওঠে, রবার্টই কি ব্যাঙ্কসি? কেবল একই এলাকার বাসিন্দা বলে নয়, ব্যাঙ্কসির চেহারা সম্পর্কে যে ধারণা পাওয়া যায়, তার সঙ্গে রবার্টের বেশ মিল আছে। শুধু যুক্তরাজ্যেই নয়, সারা বিশ্বের হাজারো দেয়াল, সড়ক আর সেতুতে ব্যাঙ্কসির গ্রাফিতি দেখা গেছে। বিষয় হিসেবে তাতে উঠে এসেছে রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি। ব্যাঙ্কসির কিছু গ্রাফিতি নাম কুড়িয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সব চিত্রকর্মের মতোই। এর মধ্যে ‘ফ্লাওয়ার থ্রোয়ার’, ‘দ্য মাইল্ড মাইল্ড ওয়েস্ট’ এবং ‘বেলুন গার্ল’ উল্লেখযোগ্য। ২০১৭ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, ‘বেলুন গার্ল’ যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় গ্রাফিতি। ব্যাঙ্কসির এই জনপ্রিয়তা গোটা গ্রাফিতিশিল্পী সমাজের জন্যই পয়মন্ত হয়ে উঠেছে। গ্রাফিতি যে একটি শিল্প এবং এর আঁকিয়েরাও যে শিল্পী, তা মানতে বাধ্য হয়েছেন বোদ্ধারা। ২০১৪ সালে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব ডিজিটাল আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সেসের ওয়েবি অ্যাওয়ার্ডে ব্যাঙ্কসিকে পারসন অব দ্য ইয়ার ঘোষণা করা হয়।

২. ডেভিড কো

দেশ: যুক্তরাষ্ট্র, জন্ম: ১৯৭৬

মা-বাবা কোরিয়ান, ডেভিডের জন্ম অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে। ক্যারিয়ারের শুরুটাও সেখান থেকে। লোকে ডেভিডকে বলে ‘সৃজনশীল বিদ্রোহী’। আঁকার বিষয়বস্তু বেছে নেওয়ার বেলায় ভীষণ সাহসী তিনি। নিজের আঁকার ধরনটিকে পরিচয় করিয়ে দেন ‘ডার্টি স্টাইল’ হিসেবে। ডেভিডের আঁকায় যৌনতার আকাঙ্ক্ষা, ধরন, অধঃপতন, উল্লাস উঠে আসে প্রায়ই। ২০০৫ সালে ডেভিডকে ফেসবুকের সে সময়ের প্রেসিডেন্ট শন পার্কার সিলিকন ভ্যালির কার্যালয়ে গ্রাফিতি এঁকে দেওয়ার অনুরোধ করেন। শন আবার ডেভিডের মহাভক্ত। কথামতো গ্রাফিতি এঁকেছিলেন ডেভিড। তাঁর বিষয়–আশয় যেমনটা হয়, তেমনই ছিল। বছর দু–এক বাদে ফেসবুকের মুখ্য নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ ফেসবুকের নতুন কার্যালয়ের জন্য গ্রাফিতি আঁকতে ডাকেন ডেভিডকে। আঁকার বিষয়ও ঠিক করে দেন জাকারবার্গ। ‘ঘাড়ত্যাড়া’ হিসেবে সুপরিচিত ডেভিড অন্যের ভাবনায় গ্রাফিতি আঁকতে রাজি হন। তবে বিনিময়ে টাকা নয়, কোম্পানির একটি শেয়ারই দাবি করে বসেন। জাকারবার্গও রাজি হয়ে যান তাতে। ২০১২ সালে ডেভিডের ওই শেয়ারের পরিমাণ উঠেছিল ২০ কোটি ডলারে!

৩. এদুয়ার্দো কোবরা

দেশ: ব্রাজিল, জন্ম: ১৯৭৬

জন্ম ব্রাজিলের সাও পাওলোর দরিদ্র পরিবারে। ছেলেবেলা থেকেই গ্রাফিতিতে মজে যান। প্রতিভার জানান দেন ১৯৯০–এর দশকে। বিশাল আয়তনের ক্যানভাস, উজ্জ্বল রং আর মোটা রেখা তাঁর কাজগুলোকে আলাদা করে দেয়। আঁকাগুলো জীবন্ত লাগে রংবাহারি জমিনে জ্যামিতিক নকশা, ছায়া ও নানান ধরনের ইফেক্টের কারণে। ত্রিমাত্রিক ছবিও এঁকেছেন কোবরা। তাঁর আলোচিত সব গ্রাফিতিতে উঠে এসেছে বিশ্বখ্যাত মানুষের মুখ। পরিবেশদূষণ, বৈশ্বিক উষ্ণতা, বন উজাড় ও যুদ্ধ নিয়ে এঁকেছেন শত শত গ্রাফিতি। ২০১৬ সালের অলিম্পিকের আগে তিন হাজার বর্গমিটার আয়তনের দেয়ালে গ্রাফিতি আঁকেন কোবরা, যা পরে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস বুকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গ্রাফিতি আর্ট হিসেবে নাম লেখায়। কোবরা কেবল ব্রাজিলে নন, সারা বিশ্বেই ওস্তাদের মর্যাদায় আসীন। এসব কারণেই বিশ্বের সেরা গ্রাফিতিশিল্পীদের তালিকায় প্রথম তিনেই আছেন তিনি।

৪. ব্লেক লে র​্যাট

দেশ: ফ্রান্স, জন্ম: ১৯৫২

হাভিয়ের প্রোউ শিল্পী হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন ১৯৮১ সালে। তাঁর প্রতিটি আঁকায় ইঁদুরের অস্তিত্ব থাকত। তাই নিজের ছদ্মনাম নেন ব্লেক লে র​্যাট। ছদ্মনামটি আবার ধার করেছিলেন ‘ব্লেক লে রক’ কার্টুন থেকে। ব্লেক ইঁদুরকে দেখেন স্বাধীনতা ও স্ট্রিট আর্ট আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে। পথেঘাটে আঁকাআঁকির সময় ধরা পড়ার শঙ্কা কাজ করত সব সময়, তাই ব্লেক এক বুদ্ধি আঁটেন। আগেভাগেই কাগজ কেটে নকশা করে রাখতেন। পরে দেয়ালের সামনে সেটি ধরে দ্রুত রং স্প্রে করে দিলেই ফুটে উঠত গ্রাফিতি। স্টেনসিল গ্রাফিতির শুরুটা সেখান থেকেই। এ কারণে ব্লেককে বলা হয় ‘ফাদার অব স্টেনসিল গ্রাফিতি’। ব্লেকের এই কৌশল এখন সারা বিশ্বেই জনপ্রিয়। খুব স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বের গ্রাফিতিশিল্পীদের কাছে ব্লেক দারুণ অনুপ্রেরণাদায়ী। ব্যাঙ্কসির মতো নামজাদা গ্রাফিতিশিল্পীও তাঁকে গুরু মানেন। ব্যাঙ্কসির ভাষায়, ‘যতবারই ভাবি একেবারে নিজের মতো কিছু আঁকব, কাজ শেষে ততবারেই আবিষ্কার করি, ব্লেক লে র​্যাট তা ২০ বছর আগেই করে ফেলেছেন!’ 

৫. ওস জিমিওস

দেশ: ব্রাজিল, জন্ম: ১৯৭৪

পর্তুগিজ শব্দ ‘ওস জিমিওস’ অর্থ যমজ। ওটাভিও প্যানডোলফো ও গুস্তাভো প্যানডোলফো—যমজ এই দুই ভাই ওস জিমিওস নামে পরিচিত। তাঁদের শুরুটা হয় ১৯৮৭ সালে। ক্যানভাস হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন ব্রাজিলের সাও পাওলো শহরের দেয়ালগুলো। মাধ্যম স্প্রে-পেইন্ট। শুরুতে যা হয়, বকাবকি, ধাওয়া—সবই খেয়েছেন। তবে ধীরে ধীরে ব্রাজিলীয় চিত্রকলায় এই দুই ভাইয়ের নাম উদাহরণ হিসেবেই উঠে আসতে শুরু করে। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে এখন তাঁরা বিশ্বের নামকরা গ্রাফিতিশিল্পীদের মধ্যে অন্যতম। শুরুতে তাঁদের আঁকায় মার্কিন হিপহপ সংস্কৃতির প্রভাব ছিল। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্রাজিলের সংস্কৃতি ফুটে উঠেছে প্রবলভাবে। গ্রাফিতির বিষয় হিসেবে তাঁরা বেছে নিয়েছেন বিচিত্র সব বিষয়। পরিবার, সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র তাঁদের প্রিয় বিষয়। এ ছাড়া ব্রাজিলের উপকথাও দেখা গেছে তাঁদের আঁকায়। বিশেষজ্ঞদের ভাষায়, ওস জিমিওসের কাজ আলাদা করা যায় স্বপ্নের মতো নান্দনিকতার গুণে।