মেঘপিয়নের ব্যাগের ভেতর...

চিঠি লিখে চলেছি প্রতিদিন। মডেল: আয়েশা, ছবি: অধুনা, স্থান কৃতজ্ঞতা: আর্ট ক্যাফে
চিঠি লিখে চলেছি প্রতিদিন। মডেল: আয়েশা, ছবি: অধুনা, স্থান কৃতজ্ঞতা: আর্ট ক্যাফে

​‘মেঘপিয়নের ব্যাগের ভেতর মন খারাপের দিস্তা,

মন খারাপ হলে কুয়াশা হয়, ব্যাকুল হলে তিস্তা।’

একটা গান শুনেছিলাম অপর্ণা সেন অভিনীত তিতলি ছবিতে। ২৬ অক্টোবর ২০১৯, এই লেখাটা যখন লিখছি, তখন প্রথম আলোর সাততলার অফিস থেকে বাইরে তাকিয়ে দেখি কুয়াশার মতো মিহি মেঘ-বৃষ্টির মশারি নেমে এসেছে আকাশ থেকে। দূরে রেললাইন এঁকেবেঁকে চলে গেছে, তার ওপারে মসজিদের মিনার মেঘ-কুয়াশায় ঢাকা। মেঘ কি আজ ডাকপিয়ন? তার ব্যাগের ভেতরে কি মন খারাপের দিস্তা দিস্তা চিঠি?

আর আমার সামনে ছড়ানো–ছিটানো অনেকগুলো খাম। হলুদ, নীল নানা রঙের ছেঁড়া খাম থেকে বের করা কত বিচিত্র কাগজে লেখা চিঠি, তাতে কতজনের মনের কত খবর।

বুদ্ধদেব বসুর একটি কবিতা আছে—

‘অচেনা, যারা আমাকে চিঠি লেখো—অসুখী, তরুণী,

কবিতার কামড়ে অস্থির যুবা—না পেয়ে উত্তর

লোকটা দাম্ভিক, ভাবো, কিংবা মানো নিজেদেরই ত্রুটি—

...

...

যখন প্রকাণ্ড হয়ে রাত্রি নামে,

আমি দেখি অন্ধকারে দূরে দূরে তোমাদের জানালায় আলো

বাঁকুড়ায়, গৌহাটিতে, বরিশালে

তোমরা আছ যে আছ

এবং আমিও আছি সেই সঙ্গে

এই তথ্য হঠাৎ ঝিঁঝির মতো বেজে উঠে

সব শব্দ স্তব্ধ ক’রে দেয়।’

এক একেকটা চিঠি যেন রংপুরে, পঞ্চগড়ে, নেত্রকোনায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কারও হৃদয়ের সলতে হয়ে পিদিম জ্বালিয়ে অন্ধকারে মিটিমিটি জ্বলছে। অন্ধকার মানে মানুষের মন, যার কোনো তল নেই, আর চিঠি মানে খোলা জানালা, মনের ১০৮ কুঠুরির একটা প্রবেশপথ।

মেঘের সঙ্গে চিঠির সম্পর্ক আছে। কালিদাসের মেঘদূত সে তো মেঘের মাধ্যমে প্রিয়াকে চিঠি পৌঁছানোর বিরহকাতর যক্ষের চেষ্টামাত্র।

কিন্তু কালিদাসের কাল তো আমরা কবেই পেরিয়ে এসেছি। আমাদের ডাকঘরগুলো উঠে যাচ্ছে, কিংবা টিকে আছে অন্য কাজের মধ্য দিয়ে। ঢাকার রাস্তায় আর লাল রঙের ডাকবাক্স দেখি না। লোকে কি আর চিঠি লেখে না? সবাই এসএমএস করে? মেসেঞ্জারে বার্তা পাঠায়, ইনবক্সে চ্যাট করে? ভিডিও চ্যাট করে?

কিন্তু অধুনার মনের বাক্সে রোজ কত চিঠিই না আসে! এই যে আমার সামনে চিঠি—জনাব মেহেদী হাসানকে একজন বলছেন, ‘রাজি থাকলে বলুন কবুল।’ পত্রলেখক বলেই নিয়েছেন, মেহেদী হাসান ছদ্মনাম। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিলয় দাস শুভ জন্মদিন জানিয়েছেন তাঁর প্রিয় স্যারকে। রিয়ানা লিখেছেন, ‘ভালোবাসি মাম্মাম।’ চিঠি পড়ে অবশ্য আমি বুঝতে পারলাম না মাম্মাম আসলে কে।

ডাক বিভাগ বিজ্ঞাপন দিয়েছিল, ‘চিঠি লিখুন, ইহা স্থায়ী।’ আর প্রমথ চৌধুরী প্রবন্ধে লিখেছিলেন, চিঠি লিখতে গিয়ে তিনি সাবধান থাকেন এ জন্য যে তা না আবার ছাপা হয়ে যায়! লেখকদের ক্ষেত্রে সে ভয় তো আছেই। রবীন্দ্রনাথের সব চিঠি শেষ পর্যন্ত ছাপা হয়ে গেল। দেশ পত্রিকা এখনো অপ্রকাশিত চিঠি খুঁজে বের করে ছাপিয়ে যাচ্ছে।

আসলে হার্ডকপির মূল্য অসীম। ফেসবুকে মিষ্টির ছবি দেখা, আর মিষ্টি চেখে দেখা—দুটোর মধ্যে পার্থক্য আছে। মাকে ফেসবুকে বলা যে আমি তোমাকে ভালোবাসি, আর মায়ের পাশে বসে তার হাতটা ধরা কি এক হলো? এ জন্যই আজও চিঠি আছে, কাগজে ছাপা বই আছে, আছে কাগজে ছাপা পত্রিকা। থেকেও যাবে।

প্রেয়সীর পাঠানো ই-মেইল আপনি কয়বার পড়বেন! কিন্তু হাতে লেখা চিঠিটায় তার স্পর্শ লেগে আছে, হস্তাক্ষরে লেপ্টে আছে তার ব্যক্তিত্বের ছাপ, কোন কালিতে লিখল, চিঠির ভেতরে গোলাপের পাপড়ি দিল কি না, কিংবা মিশিয়ে দিল কি না কিছু সুরভী, এসব মেইলে কোথায় পাব!

গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের কলেরার দিনগুলিতে প্রেম উপন্যাসের নায়ক নায়িকাকে চিঠি লিখেছিল অসংখ্য। শেষজীবনে এসে দুজনের মধুর মিলন। ইতি তোমারই অমৃতা নাটকটি তো মঞ্চে বসে দুজনার চিঠি পাঠ। মূল ইংরেজিটা এ আর গার্নির অ্যামেরিকান প্লে, লাভ লেটারস। চিঠির আকারে উপন্যাস লিখেছেন কাজী নজরুল ইসলাম, নাম বাঁধনহারা। কেতকী কুশারী ডাইসনের নোটন নোটন পায়রাগুলি, বুদ্ধদেব গুহের সবিনয় নিবেদন, বনফুলের কষ্টিপাথর, শৈলজানন্দের ক্রৌঞ্চমিথুন, সন্তোষকুমার ঘোষের শেষ নমস্কার­­—শ্রীচরণেষু মাকে, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাঁচের দরজা, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ইতি তোমার মা—চিঠিতে চিঠিতে লেখা কাহিনিগ্রন্থের কিছু উদাহরণ।

আমি তো তরুণদের বলি, কাগজের বই কাগজের পত্রিকা হাতে নিয়ে পড়ো। উপন্যাসের মধ্যে ডুবে যাও। কল্পিত চরিত্রদের দুঃখে কাঁদো। ভালো মানুষ হবে। এই অস্থির সময়ে আমাদের চাই শান্ত সুস্থির ভালো মানুষ। ভালো মানুষেরা দুনিয়াটাকে পরিপূর্ণ করে তুলুন ভালো দিয়ে আর আলো দিয়ে।

মনের বাক্সে আসা চিঠির বহর দেখে, প্রথম আলোর বুধবারের ক্রোড়পত্র অধুনার মনের বাক্সের চিঠিগুলো পড়ে আবারও আস্থা জাগে, এই পৃথিবীতে এখনো মানুষের অনুভূতি মরে যায়নি। মানুষ ভালোবাসতে জানে, এবং জানে চিঠি লিখতে।

আনিসুল হক, কথাসাহিত্যিক