বলেছিলে তাই চিঠি লিখে যাই

>
এখনো মানুষ মনের কথা প্রকাশ করতে চিঠির আশ্রয় নেয়। মডেল: অসিন, ছবি: সুমন ইউসুফ
এখনো মানুষ মনের কথা প্রকাশ করতে চিঠির আশ্রয় নেয়। মডেল: অসিন, ছবি: সুমন ইউসুফ
৪ নভেম্বর প্রথম আলোর ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে অধুনার মনের বাক্স নিয়ে বিশেষ আয়োজন করার ঘোষণায় বিপুলসংখ্যক পাঠক সাড়া দিয়েছেন। পাঠকের চিঠিতে ভরে গেছে আমাদের লেটার বক্স, ই–মেইল আর ফেসবুকের ইনবক্স। সেখান থেকে বাছাই করা কিছু চিঠি থাকল আজ অধুনার বিশেষ আয়োজনে।

আজ বলি, তোমাদের খুব ভালোবাসি

পৃথিবীতে ভালোবাসি কথাটা না বলেও যাঁদের সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি তাঁরা হলেন মা–বাবা। মুখ ফুটে কখনো বলা হয়নি, তোমাদের ভালোবাসি। আজ এই প্রথম আলোর মাধ্যমে এখানে লিখে জানাতে চাই, আব্বু-আম্মু তোমাদের খুব ভালোবাসি।শাফিম আমার ছোট ভাই, তোকেও খুব ভালোবাসি।

আজ আমরা দুই ভাই মা–বাবাকে ছেড়ে দূরে পড়াশোনা করছি। মা–বাবার খুব চিন্তা হয়। মা–বাবা তোমরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছ আমাদের জন্য। তোমরা আমাদের সব প্রয়োজন মেটাও। আমাদের কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে তোমাদেরই আগে মনে পড়ে। সারাক্ষণ আমাদের ভালোবেসেই যাচ্ছ, কিন্তু প্রতিদানে কিছুই চাচ্ছ না। আমরা যত কষ্ট দিই, দুঃখ দিই তারপরও আমাদের ভালোবেসে যাচ্ছ।

আমাদের স্বপ্ন পূরণের জন্য তোমরা পরিশ্রম করে যাচ্ছ। কখনো নিজের জন্য তোমাদের কিছুই চাইতে দেখিনি সব সময় আমাদের জন্যই চেয়ে যাচ্ছ। তোমাদের অসুস্থতার কথা শুনলে চিন্তা হয়। দোয়া করি, সব সময় সুস্থ থাক। মন খারাপের সময় তোমাদের সঙ্গে কথা বললে মন ভালো হয়ে যায়। তোমাদের হাত ধরে জীবনের প্রথম বইয়ের পাতা ওলটানো শেখা। পৃথিবীতে তোমাদের মতো মা–বাবা থাকলে আর কোনো কিছুর প্রয়োজন হয় না। হাজারবার জন্ম নিয়েও তোমাদের ঋণ কখনো শোধ করা যাবে না। তোমরা পাশে থাকলে নিষ্ঠুর দুনিয়াটাকেও সুন্দর মনে হয়। তাই শুধু এটুকু বলতে চাই, তোমাদের খুব ভালোবাসি।

আশরাফুল হক 
রুকুন্দি, মেহেন্দীগঞ্জ, বরিশাল। 

কেমন আছ তুমি? 

প্রিয় মা,
কেমন আছ তুমি? তুমি তো জানোই, তোমাকে ছেড়ে কতশত ক্রোশ পথ পাড়ি দিয়ে দূরে আছি আমি। তোমাকে খুবই মনে পড়ে, সেই ছোট্টবেলার কথাগুলোও। তোমাকে কাজে বিরক্ত করতাম; যেটা বলতে, সেটা না শুনে চলে যেতাম। মাঠে খেলতাম, ঘুরে বেড়াতাম। প্রতিদিন অভিন্ন রকমের বকা খেয়ে স্কুলে যেতাম। সবই খুব মনে আছে। মনে পড়ে, শয়নে–স্বপনে, ঘুম–জাগরণে। মনে পড়ে, তোমার স্নেহ–ভালোবাসার টান, মনে পড়ে, তোমার রান্নার অপরূপ ঘ্রাণ।

সেদিন ফোন করে তুমি আমাকে অভিযোগ করেছিলে, আমি শুধু প্রতিদিন বাবা আর ছোট ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলি, তোমার সঙ্গে কথা বলি না। তোমাকে নাকি আমার মনেই পড়ে না, তোমার এই অভিমানী অভিযোগ সাদরে মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছি। কথা বলি না, তার মানে এই না, তোমাকে মনে পড়ে না।

এটা তোমার দিব্যি ভুল ধারণা। এই তো কিছুদিন আগে, ভিডিও কলে কথা বলছিলাম, সবার সঙ্গেই বেশ হাসিখুশিভাবেই বলছিলাম।

কিন্তু যখন তোমার সঙ্গে কথা বলেছি, তখন তুমি আমাকে দেখামাত্রই কেঁদে দিলে।

তোমার মায়াবি আঁখি বেয়ে জলসিক্ত ভালোবাসাগুলো, টলমল করে গড়িয়ে পড়ছিল। তুমি কি জানো, তখন আমার হৃদয়ে হাহাকার বইছিল? তোমাকে যে কত ভালোবাসি, সে কথাটা হয়তো চিৎকার করে মুখ খুলে কখনো বলিনি। শুধু অনুভবে যে কতবার বলেছি, বলতে পারব না।

কখনো অভিমান কোরো না।

মা,
দূরে আছি বলে,
অন্তরপূর্ণ এই অসীম ভালোবাসা
কখনো যাবে না চলে।
শুধু এটা মনে কোরো,
আমি তোমার কাছেই আছি, তোমার পাশেই আছি।
মা, তোমাকে অনেক ভালোবাসি।
ইতি,
তোমার স্নেহের
সুমন।

মো. সুমন সরকার 
অর্থনীতি বিভাগ, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর।

না বলা ভয়ের কথা

জানালা বন্ধ...তবে তীব্র বাতাসের শাঁ শাঁ শব্দ আসছে। এদিকে আমার মোমের আগুন লাফিয়ে লাফিয়ে কী যেন জানান দিচ্ছে। কিন্তু মোমের ভাষা আমার জানা নেই। তাই আমার কথাগুলোর মতো মোমের কথাও অব্যক্ত। একটু পরই বুঝলাম অনেকটা সময় চলে গেছে, ঝড় এসেছে ঠিকই। কিন্তু আগে যে ভয়টা পেতাম, সেটা এ বছর নেই। কিন্তু ভয়টা গেল কোথায়? নাকি ট্রান্সফার হয়ে অন্য কোনো ঘটনায় যোগ দিল? হতে পারে। আগে হাসতে ভয় পেতাম না, কোনো দায়িত্ব পালনের ভয় অথবা কে কী ভাববে সে ভয়, না না পেতাম না।

রাতের ওই বজ্রপাতের শব্দ আগে যেভাবে ভয় দেখাত। এখনো দেখায় আরও তীব্রভাবে। তবে বজ্রপাত হয়ে নয়! মানুষই ভয় দেখায়। প্রত্যেক মানুষ এক একটা বজ্রপাত ধারণ করে, তারপর শুভাকাঙ্ক্ষী সাজে। বজ্রপাত তো তা–ও আলোর দ্রুত গতি দিয়ে আগাম কিছু সতর্কবার্তা পাঠায়...মানুষেরা তা পাঠাতেও নারাজ। 

সুমাইয়া রিতু
মিরপুর, ঢাকা।

একাকীর জন্য

প্রিয় একাকী,
১৬ অক্টোবর মনের বাক্সতে আপনার লেখাটি পড়লাম। আপনি বলেছেন জীবনটা ছোট, পৃথিবীটা গোল। তাহলে এই অল্প জীবনে প্রেমে পড়া উচিত নয় কি? যেখানে আজীবন থাকবেন সেখানকার জন্য সঙ্গী নির্বাচন করা উচিত বলে আমি মনে করি। হয়তো আপনি ভালো ছেলে তাহলে সম্পর্কে মগ্ন থাকা পুরুষেরা কি মন্দ? একাকী জীবন ক্ষণিকের জন্য মজাদার কিন্তু দিন শেষে প্রিয়জনের সঙ্গে একটু আড্ডা দিয়েই দেখুন না জীবনটা আরও মজাদার হবে। সত্যি ভালো ছেলে হলে বারবার নয়, প্রতিবারই বারবার একইজনের প্রেমে পড়বেন। মিসড কল না, দুজন দুজনের কণ্ঠ শোনার জন্য অপেক্ষা করবেন। খুনসুটি আর ভালোবাসায় একাকিত্ব ঘুচে যাবে।

আর হ্যাঁ সময় করে ১৬ অক্টোবরের অধুনার ৩ নম্বর পৃষ্ঠাটা পড়বেন ‘একে অপরের পাশে থেকে সহনশীলতার চর্চা করুন, মন উদার রাখুন।’

নুসরাত, ঢাকা।

আব্বু কলিং

আব্বু শব্দটি আমার আজও সঠিকভাবে উচ্চারণ করা হয়নি। আমাদের আব্বু একটু অন্য রকম বন্ধুই ছিল। আব্বু থাকলেই যেন পুরো বাড়ি হইহুল্লোড়ে ভরে যেত। এখনো মনে পড়ে বিশ্বকাপ ফুটবলে রাত দুইটা অবধি ম্যাচ দেখা, গোল হলেই সে কী চিল্লাপাল্লা! আব্বুর সঙ্গে লুকিয়ে কত যে কার্টুন, ভূতের ছবি দেখেছি। যেদিন ধরা খেতাম আম্মুর কাছে, সেদিন কপালে আর বকার সীমা থাকত না। আমাদের বাড়িতে তো রীতিমতো টক শো চলত। রাজনৈতিক, সামাজিক, খেলাধুলা, পড়াশোনা—বাদ পড়ত না কিছুই। এই মানুষটি যখন আবার কষ্ট পেত, একেবারে শান্ত হয়ে যেত, অথচ কারও প্রতি কোনো অভিযোগও থাকত না। আব্বু ছাড়া এখন সবকিছুতে মনে হয় যেন একরাশ শূন্যতা ভর করে আছে।

মানুষ যখন থাকে, কতটা মায়া জড়িয়ে নেয়; আবার সেই মায়া ত্যাগ করেও চলে যেতে হয়।

তোমার এই রেখে যাওয়া মায়াটা আমরা হয়তো কোনো দিনই কাটিয়ে উঠতে পারব না, আব্বু। বাড়িতে যখন কেউ থাকে না, তখন আমি আব্বুর সঙ্গে কথা বলি। কতবার আব্বু বলে ডাকি! শুধু সবার সামনেই ডাকতে পারি না। আমার ফোন সাইলেন্ট থাকত বিধায় আব্বুর কল রিসিভ করতে পারতাম না। আব্বু সব সময় বলত, ‘বাবা, আছি বলেই ফোন দিই, না থাকলে কেউ দেবে না।’ সত্যিই তো ফোনের স্ক্রিনে ‘আব্বু কলিং’ লেখা আর আসে না। আমি কিন্তু রোজ ডায়াল লিস্টে একবার হলেও তোমাকে রাখি। সরাসরি কথা হয়তো হয় না, কিন্তু জানো, নির্ভরতা পাই, সাহস পাই, পাশে তো তুমি আছই।

ইতি
তোমার সামি
সামিয়া ফারিহা, রসায়ন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

আমিও যে হিমু হতে চাই

ভালো লাগাটা আসলে খুব তাড়াতাড়ি হয় না। আমার ক্ষেত্রেও তেমন। সবাইকে চমকে দিয়ে আমি তাঁকে সেদিন বিব্রত করেছিলাম। তবে বলিনি কিছুই। বলিনি বললেও আসলে ভুল হবে; বলতে পারিনি বললে হয়তো ঠিক হতো। জানি, ভালো লাগাটা হয়তো তাঁর তখন ছিল না। তবে আমার কাছে যে ছিল অঢেল। বুঝল সে, আমিও যে তাঁর মনের একজন প্রার্থী।

তাঁকে আমি প্রায় বাধ্যই করেছি আমার প্রতি তাঁর ভালো লাগাটা কাজ করাতে। ভালো না লাগবেই বা কেন? তাঁর প্রতিটা সকালের সূর্য যে ছিলাম আমি, ডুবন্ত সূর্যের বেলাতেও ছিলাম আমি, লুকিয়ে তাঁকে দেখার মানুষটাও যে ছিলাম আমি। সেটা হয়তো সে কোনো না–কোনোভাবে টেরও পেয়ে গিয়েছে।
হ্যাঁ, তাই তো এখন ডাকে সে আমাকে। আমি যাই না। কারণ, হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, ভালোবাসার মানুষদের খুব কাছে কখনো যেতে নেই।
তাই তো আমি যাই না। কারণ, আমিও যে হিমু হতে চাই।

সাইফুল ইসলাম
ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ঢাকা কলেজ, ঢাকা।

নরেন স্যারকে মনে পড়ে

১৯৯৬ সাল। প্রাথমিকের পাট চুকিয়ে মাত্র মাধ্যমিকে পা দিয়েছি।

ফুরফুরে মেজাজ। ভাবখানা এমন যেন অনেক বড় হয়ে গেছি!

এরই মধ্যে ভয়ানক দুঃসংবাদ হয়ে এলেন ইংরেজির শিক্ষক নরেন স্যার। বড় ভাইদের কাছ থেকে নাকি জানা গেছে, নরেন স্যারের মতো কৃপণ শিক্ষক এই পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। না, অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে তাঁর কোনো কার্পণ্য নেই। কিন্তু কাউকে নাকি তিনি নম্বর দিতে চান না। তাঁর ক্লাসে নাকি কেউ পাস করতে পারে না! মহাদুশ্চিন্তার বিষয়!

কথাটা একেবারে মিথ্যা নয়। প্রথম সাময়িক পরীক্ষার খাতা দিলে এর প্রমাণ মিলল। প্রায় সবাই ফেল! যা দু-একজন পাস করেছে, তারাও চল্লিশ পেরোতে পারেনি। আমি পেয়েছি মাত্র ৩৭। চরম লজ্জার বিষয়। বাড়িতে মুখ দেখাব কী করে? ক্লাসে বরাবর প্রথম হওয়া ছেলেটিরও এ অবস্থা!

আমার বড় চাচা মাস্টার ইসমাইল হোসেন গাজী ছিলেন নরেন স্যারের বন্ধু। তিনি অন্য একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। দুজনই এসএসসির ইংরেজি খাতা দেখতেন। এক্সট্রা অর্ডিনারি কোনো খাতা পেলে দুজনে পরামর্শ করে নম্বর দিতেন। উভয়েরই উভয় বাড়িতে বেশ যাওয়া-আসা ছিল। 

আমরা বড় চাচাকে বাবু বলে ডাকতাম। সব আবদার যেমন ছিল তাঁর কাছে, তেমনি সাংঘাতিক ভয়ও পেতাম তাঁকে। নিয়ম ছিল, যেদিন কোনো বিষয়ের খাতা দেবে, রাতে তা বাবুকে দেখাতে হবে। খাতাটা উল্টেপাল্টে দেখার পর বাবু আমার দিকে তাকালেন। ভয়ে আমার পরান দুরুদুরু করছে! কিন্তু তিনি আমাকে তেমন কিছু বললেন না।

শুধু বললেন, দেখ, তোমার নরেন স্যার আমার দেখা শ্রেষ্ঠ ইংরেজি শিক্ষক। ইংরেজিতে তাঁর মতো পণ্ডিত আমাদের উপজেলাতে তো বটেই, বাংলাদেশেও আছে কি না, আমার সন্দেহ। তিনি এবড়োখেবড়ো মার্কিং করেন না। সব কটি খাতার লাইন বাই লাইন পড়ে নম্বর দেন। অতঃপর বাবু খাতার ভেতরে আমার করা বানান ভুল, ব্যাকরণগত ভুলসহ অন্য ভুলগুলো বুঝিয়ে দিলেন। আর বললেন, তোমাকে নরেন স্যারের কাছে ইংরেজি শিখতে হবে।

পরদিন স্কুলে গিয়ে নরেন স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করলাম। স্যার বললেন, দেখ, আমি তো কাউকে প্রাইভেট পড়াই না। আমি আমার বাবুর ইচ্ছার কথা বললাম। তিনি একটু চুপ করে রইলেন। এরপর বললেন, ঠিক আছে, গাজী যখন বলেছে, তোমাকে পড়াব। তবে একটি শর্তে। শর্ত! আমার সপ্রশ্ন চাহনি।

স্যার বলে চললেন, পড়ানোর বিনিময়ে আমাকে কোনো টাকা দিতে পারবে না! 

এরপর শুরু হলো প্রতিদিন ভোরে স্যারের বাড়িতে যাওয়া। এত দিন যারা স্যারকে জমের মতো ভয় পেত, আমার দেখাদেখি তারাও সকালে স্যারের বাড়িতে যাওয়া শুরু করল। স্যারও না করতে পারলেন না। আমার শেখার আগ্রহ ও ক্ষমতা দেখে স্যার মুগ্ধ হলেন। মাধ্যমিকে পুরো সময়টা স্যারের কাছে ইংরেজি পড়েছি। একটি পয়সাও নেননি। কোনো কোনো সময় তিনি আমাকে দিনে দুবেলা, ভোরে এবং স্কুল ছুটির পরে, ইংরেজি শেখাতেন। আমি স্কুলে টিফিন নিয়ে যেতাম। স্যার স্কুল শেষে এক টুকরো পাউরুটি কিংবা একটা শিঙাড়া আর এক কাপ চা খেয়ে আমাকে পড়াতেন। সেই পাউরুটি থেকে আবার আমাকে একটু দিতেন। আমি লজ্জা পেতাম। বেশ খারাপ লাগত। বলতাম, স্যার, বিকেলে পড়ানোর দরকার নেই। স্যার বলতেন, সামনে তোমার বৃত্তি পরীক্ষা, আমার দুপুরে এটুকু খাবারই যথেষ্ট!

অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পরীক্ষা দিলাম। গ্রাম থেকে জেলা শহরে গিয়ে প্রথম পরীক্ষা। নানা কারণে পরীক্ষা মনমতো হলো না। দুদিন যাবৎ পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরেছি, রান্নাঘরে বসে ভাত খাচ্ছি, এমন সময় নরেন স্যার সাইকেল চালিয়ে আমাদের বাড়িতে এলেন, আমার পরীক্ষা কেমন হয়েছে জানার জন্য। প্রশ্নপত্র দেখতে চাইলেন। 

আমি বললাম, স্যার, হবে না, পরীক্ষা ভালো হয়নি। প্রশ্ন দেখে লাভ নেই। আপনি খামোখা মনে কষ্ট পাবেন। 

নাছোড়বান্দা হয়ে স্যার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্নপত্রগুলো আর আমার উত্তরগুলো মেলালেন। বিশেষ করে ইংরেজিরটা। অতঃপর স্যার বললেন, কে বলেছে হবে না। অবশ্যই হবে। তুমি বৃত্তি পাবে। আমি বললাম, স্যার, আপনি কষ্ট পান, এটা আমি চাই না। 

এর বেশ কিছুদিন পর এক সন্ধ্যায় পরিচিত এক দাদা খবর নিয়ে এলেন। আমি বৃত্তি পেয়েছি। হরিণা স্কুলের প্রধান শিক্ষক সাধন স্যারের কাছে রেজাল্ট শিটটা আছে। বাবু আমার বড় ভাইয়া আর আমাকে সাধন স্যারের বাসায় পাঠালেন। আমাকে সাইকেলের পেছনে চড়িয়ে আমার মিয়া ভাই রাত নয়টায় সাধন স্যারের বাসায় পৌঁছালেন। 

মিষ্টি নিয়ে বাসায় যখন ফিরলাম, তখন বাবু শুয়ে পড়েছেন। তাঁকে ডেকে তুললাম। জানালাম ঘটনা সত্যি।

তাঁকে মিষ্টি খেতে বললাম। তিনি খেলেন না। বললেন, আগে তোমার নরেন স্যারকে মিষ্টি খাইয়ে আসো। তাঁকে না খাইয়ে আমি মিষ্টি খেতে পারব না। 

পাশের গ্রামে স্যারের বাড়ি। মিষ্টি নিয়ে স্যারের বাসায় গেলাম। মিয়া ভাই আর আমি। দেখলাম, খাটের ওপর বসে স্যার খাতা দেখছেন। তাঁর হাতে মিষ্টি দিয়ে বললাম, স্যার, আপনার কথা সত্যি হয়েছে, আমি বৃত্তি পেয়েছি।

স্যার বললেন, বলেছিলাম না, হবে! এরপর স্যার তোয়েলে দিয়ে চোখ মুছতে লাগলেন। আমাদের চোখও ভরে উঠল লোনা জলে। কোনো কোনো আনন্দ মানুষের চোখে দুঃখের চেয়ে বেশি অশ্রু ঝরানোর ক্ষমতা রাখে, তা সেদিন জানলাম। মনে আছে, আমার বৃত্তি পাওয়ার আনন্দে পরদিন স্কুলের সব ক্লাস সাসপেন্ড করা হয়েছিল। 

অনেক বছর পর। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। ছুটিতে বাড়ি গেলেই নরেন স্যার আর কাকিমার সঙ্গে দেখা করে আসি। স্যার স্কুল থেকে অবসরে গেছেন। পুরোনো ছাত্রদের সঙ্গ তাঁর ভালো লাগে।

সেবার অনেক দিন পর বাড়িতে গেলাম। প্রত্যন্ত গ্রামে আমাদের বাড়ি। পৌঁছাতে রাত হলো। রান্নাঘরে বসে ভাত খাচ্ছি। মা হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছেন। হঠাৎ বলে উঠলেন, বাবা, তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি। তোমার অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা ছিল, তাই ফোনে জানাইনি। খেতে খেতে আমি বললাম, কী কথা মা? ‘তোমার নরেন স্যার গত পরশু মারা গেছেন’—মায়ের উত্তর।

মনে হলো আমার হাত কয়েক শ মণ ভারী হয়ে গেছে। আমি আর তা তুলে মুখের কাছে নিতে পারলাম না। মনে আছে, চোখ দিয়ে কোনো অশ্রু ঝরেনি। হঠাৎ আসা দমকা ঝড় যেমন সব ধুলা উড়িয়ে নিয়ে যায়, আমার চোখের অশ্রুও বোধহয় সেদিন সেভাবে শুকিয়ে গিয়েছিল। সারা রাত দুচোখের পাতা এক করতে পারিনি।

স্যারের এভাবে চলে যাওয়া, তাঁর সঙ্গে শেষ দেখা না হওয়ার ক্ষতটা আমার বুকে আজও লেপ্টে আছে। হয়তো আমৃত্য তা মুছবে না। 

মঈন যশোরী
তথ্য কর্মকর্তা (বিসিএস-তথ্য),
আঞ্চলিক তথ্য অফিস, পিআইডি, খুলনা।

সেইসব দিনগুলো

চুরি করে প্রথম ধরা খাওয়া। কোন ক্লাসে ঠিক মনে নেই। খটমট ইংরেজি বইয়ের, ‘হ্যালো করিম, মানে ওহে করিম’—এ জাতীয় পড়ার ফাঁকে ফাঁকে বইয়ের নিচে লুকিয়ে ঠাকুরমার ঝুলি পড়া, ছোট মামার হাতে কানমলা খাওয়া। মামা তখন বিএ ক্লাসের ছাত্র। প্রথমবার বাংলা সাহিত্যে ফেল করে, বোনের বাসায় থেকে নব উদ্যমে দিনে ১৬ ঘণ্টার মতো পড়াশোনা করেন আর দিনরাত রবিবাবুকে গালমন্দ করেন। নিজেকে তিনি তখন রবার্ট ব্রুসের মতো একজন মনে করেন। বাসায় পড়া ছাড়া তাঁর আর কোনো কাজ না থাকায়, মাঝেমধ্যে আমার পড়াশোনার তদারকি করে আমাদের পরিবারে ওনার প্রয়োজনীয়তা জানান দেন।

মামা সাহিত্যের ফেলটুস ছাত্র এবং আমার প্রথম অপরাধের কারণে মনে হয়, সে যাত্রা বেঁচে গেলাম। আম্মুর কানে তোলার হুমকি দিয়ে ছেড়ে দিলেন। মামা দীর্ঘক্ষণ ধরে এক জিনিস এতবার পড়তেন যে আমারই মুখস্থ হয়ে যেত। কিছু কিছু লাইন এখনো মনে আছে। যেমন, নববর্ষের মেঘ দেখে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গায়ে শিহরণ জেগেছিল। কোনো এক মেঘাচ্ছন্ন দিবসে আত্মবিশ্লেষণের মুহূর্তে কবির মনে হয়েছিল...।

আমি মাঝেমধ্যে মামাকে তাঁর পড়া বলে চমকে দিতাম। যা হোক, টানা তিন দিন স্কুলে গিয়ে, তিন টাকা জমিয়ে কেনা ঠাকুরমার ঝুলি বইটি, চুরি করে পড়া শেষ করে লুকিয়ে ফেললাম। সেখানেই আমার বাল্য–সাহিত্যচর্চার প্রথম ধাপের ইতি।

প্রিয়াংকা রানি সিংহ। ষষ্ঠ শ্রেণির সবচেয়ে দুরন্ত ছাত্রী। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ শুনতে শুনতে শিক্ষকদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। পাশে যে বসত, তাকে সে ঠেলে বেঞ্চ থেকে ফেলে দিত। শক্তিতে তার সঙ্গে পারে, এমন কেউ ক্লাসে ছিল না। রবীন্দ্রনাথের সমাপ্তি গল্পের মৃণ্ময়ীর মতো ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রীমহলে সে ছিল এক বর্গীর মতো উপদ্রব। একবার এক ছাত্রীকে হাতের নখ দিয়ে খুঁচিয়ে স্কুলে হুলুস্থুল কাণ্ড বাঁধিয়ে দেয়। প্রধান শিক্ষিকা তার বাবাকে ডেকে মেয়ের দস্যিপনার জন্য কড়া করে সতর্ক করে দিলেন। তবে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে, এই মেয়েটি আমার প্রতি অগাধ মমতা অনুভব করত। কতদিন দুজন মিলে টিফিন ভাগাভাগি করে খেয়েছি।

প্রিয়াংকা আমাকে ওর মামার দেওয়া একটা বই পড়তে দেয়। সাদা কাগজের প্রচ্ছদে কমলা রঙে বড় বড় করে লেখা, শরৎ শ্রেষ্ঠ গল্পসমগ্র। ‘বিন্দুর ছেলে’ ও ‘মেজদিদি’ পড়ে ফেললাম। এরপর একদিন স্কুল ছুটির পর, সিংহের হাত ধরে জীবনে প্রথম বইয়ের দোকানে যাই। আমাদের ছোট্ট মফস্বল শহরে তখন তিনটি মাত্র বইয়ের দোকান। একটিতে অল্পস্বল্প গল্প, উপন্যাসের বই পাওয়া যায়। হাইস্কুল মোড়ের বিদ্যাবিপণি থেকে প্রথম বই কেনা। একে একে আমি আর সিংহ টাকা জমিয়ে জমিয়ে বই কিনতে শুরু করলাম। পথের পাঁচালী, অপরাজিত, শ্রীকান্ত, চরিত্রহীন। কিশোরী বয়সে প্রথম চরিত্রহীন–এর সতীশ চরিত্রের প্রেমে পড়ি। সিংহ আজ কোথায় আছে, জানি না।

বাড়িতে আম্মুর কলেজজীবনের কিছু বই ছিল, যেগুলো আমাদের পড়তে দেওয়া হতো না। বার্ষিক পরীক্ষার পর আবদার করলে, পড়তে দিতেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের নাটক শাহজাহান ও তাঁর স্কুলের দ্রুতপঠন বইগুলো। দ্রুতপঠন বইগুলো দ্রুত শেষ করলেও নাটকের প্রতি আগ্রহ তখনো তৈরি হয়নি। উল্টেপাল্টে ফেরত দিয়ে দিতাম। একবার আম্মুর চোখ ফাঁকি দিয়ে তাঁর সংগ্রহ থেকে পড়ে ফেলি দেবদাস ও শেষ বিকেলের মেয়ে।

নিশির সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের শুরু অষ্টম শ্রেণিতে। ক্লাসের সুশ্রী মেয়ে। আড্ডা দিতে দিতে আকাশ ফাটিয়ে হাসতাম আমরা। সেই মুহূর্তে আমি বোঝার চেষ্টা করতাম, এই মেয়েটিকে আমি কতটা পছন্দ করি। মাঝেমধ্যে ঢাকায় ওর চাচার বাসায় গেলে বই নিয়ে আসত। হিমু রিমান্ডে, টুকুনজিল, নায়ীরা দিনের পর দিন বুঁদ হয়ে পড়তাম। তত দিনে ছোট মামা বিএ পাস করে কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেছেন আর আমিও ছিঁচকে চোর থেকে পাক্কা চোরে পরিণত হয়েছি।

আজ এই ব্যস্ত নগরীতে নিশি এখনো আমার এক টুকরো অক্সিজেন হয়ে আছে। কিন্তু হায়, সিংহকে আমি হারিয়ে ফেলেছি। জীবনের চলমান রেলগাড়িটা থেকে, কোনো এক অজানা স্টেশনে সে নেমে গেছে। সোনারাঙা সেই সময় তরির নিমজ্জিত গলুইয়ে খুঁজে বেড়াই। এক বাঁও মেলে না, দো বাঁও মেলে না।

সায়মা সুলতানা

ফিরে দেখা

প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে দুধ–মুড়ি খেয়ে সাইকেল নিয়ে স্কুলে যাওয়া। মিস করি স্কুলের ফুটবল, ক্রিকেট খেলা, খেলার জন্য সাত্তার স্যারের পিটুনিগুলো, ব্রাজিল–আর্জেন্টিনা নিয়ে অমীমাংসিত সেই তর্কাতর্কি। সাকিব, দারুল, আতিকুর, লোকমান, স্টার, সবুজদের সঙ্গে কাটানো কিছু অমলিন স্মৃতি। মিস করি ক্লাসে বসে হাসাহাসি করা। এত দিন পরও প্রতিবার ছুটিতে বাসায় গিয়ে যখন স্কুলে যায়, কিছুটা নস্টালজিয়ায় ভুগি! সেখানে দাঁড়িয়েই যেন অতীতকে দেখতে পায়, ওই তো আমি ছোটাছুটি করছি, ওই তো আমার বলে লোকমান বোল্ড হয়ে কান্না করছে কিংবা দারুল ছক্কা মেরে হাসছে!

আরশিল আজিম
দশম শ্রেণি, ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ পার্বতীপুর, দিনাজপুর।

ভালো থেকো প্রিয়

আশা করি ভালো আছ। কিন্তু আমি জানি, তুমি ভালো নেই, হয়তো তার কারণটাও আমি। হয়তো আমরা কখনো একে অপরকে সামনে থেকে দেখতে পাব না, ভালোবাসা শুধু মুঠোফোনেই বন্দী হয়ে থাকবে। তোমার বিশ্বাস ভাঙারই ফল এগুলো, সেটা বুঝতে বাকি নেই আমার। তোমার ভাঙা বিশ্বাসটা আর জোড়া লাগাতে পারিনি বলেই মাত্র ২২০ কিলোমিটার দূরে থেকেও দূরত্বটা হাজার মাইলের মনে হয়। অনেকবার তো জানতে চেয়েছিলে, কতটা ভালোবাসি তোমায়, কিন্তু একবারও তোমার মনের মতো উত্তর মনে হয় দিতে পারিনি।

তাই আজ প্রথম আলোর ৭৬ লাখ পাঠকের সঙ্গে তোমাকেও জানিয়ে দিলাম, সত্যি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। পৃথিবীতে তো অনেক মানুষই তাদের ভালোবাসার মানুষকে ছাড়া থাকে, আমরাও না হয় থাকলাম। তুমি আমাকে ছাড়াই ভালো থেকো প্রিয়। কারণ, জীবন তো কারও জন্য থেমে থাকে না।

জিসাদ আল হাসান
একাদশ শ্রেণি
কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, রংপুর

স্মৃতিতে এসএম হল

কত মানুষ আসে যায়, শুধু বাবলু ভাই রয়ে যান। অনেক মানুষের সেই পরিচিত মুখ আমাদের বাবলু ভাই। যিনি সারা দিন ছুটে বেড়ান পাখির মতো। যাঁর শরীরে নেই কোনো অলসতা। কবে যে এখানে এসেছিলেন, তা–ও ঠিক মনে নেই বাবলু ভাইয়ের। একদিন জিজ্ঞাস করলাম, ‘ভাই আপনি এখানে আছেন, আপনার কষ্ট লাগে না?’

বাবলু ভাই বললেন, ‘আমার আবার কষ্ট লাগে নাকি। আমি তো পাথর। কারণ, সবাই আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু আমি কজনকে ভালোবাসতে পারলাম?’ কষ্ট লাগত প্রথম যখন এখানে এসেছিলাম। এখন আর কষ্ট লাগে না। কারণ, কষ্টগুলো অনেক আগেই মরে গেছে। কী অদ্ভুত মানুষ! আমরা এখান থেকে চলে যাব। সবাইকে মনে পড়বে। কিন্তু বাবলু ভাইয়ের মনে পড়বে না?

অবশ্যই পড়বে কিন্তু মনে করার সময় তো বাবলু ভাইয়ের নেই। তোদের সঙ্গে কাটানো দিনগুলো মনে থাকবে। মনে থাকবে এসএম হলের স্মৃতিগুলোর কথা।

মো. নাছির উদ্দিন
হিসাববিজ্ঞান বিভাগ,
সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনা। 

আয়ুর বিনিময়ে যদি কিছু সময় ফিরে আসত

জানিস? আমার সময়গুলো খুব একা যায়। প্রতিটা সময় তোদের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে স্কুলের দিনগুলোর কথা। ইশ্​, কী সময়গুলোই না ছিল। এখন আমি আছি আমার মতো আর তোরা তোদের মতো। অনেক দিন তোদের সঙ্গে দেখা হয় না। শান্তিতে কথাও হয় না।

নশিন, আগে যখন একসঙ্গে স্কুল শেষে বাসায় ফিরতাম কত–ই না মজা করতাম। চোখেমুখে ছিল উচ্ছাস আর হাসি। মাঝেমধ্যে তো ঝগড়া করতাম, মান–অভিমানের পালাও চলত। এখন ব্যস্ত জীবনে কথাও হয় না, মনের মধ্যে কত না কথা জমে আছে। এসএসসি পরীক্ষার পরের সময়টা কেটেছে তোমার সঙ্গে গল্প করে। ঘুম, খাওয়া, গোসল বাদে বাকি সময়টা চ্যাটিং করতাম, কোথায় গেল সময়টা?

সামিয়া, তোমার সঙ্গে ১২টা বছর কেটেছে আমার। আমার শৈশব, কৈশোর কেটেছে তোর সঙ্গে। দেখলি, এখনো তুমি আর তুই মিশিয়ে কথা বলার অভ্যাসটা রয়ে গেল। তোর মতো বেস্ট ফ্রেন্ড আসলে সবার কপালে জোটে না। তুই কি আমার মাইরগুলো মিস করিস? 

মৌণ, কেমন আছ? এখন তো আর আমার সঙ্গে চ্যাটিং করতে হয় না পড়ার ফাঁকে। তাই তো আন্টির বকাও শুনতে হয় না, তাই না? মনে আছে আমাদের দুজনের সেই সময়গুলো? আহ্​, মনে পড়তেই ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে। কখনই ফিরে আসবে না সময়গুলো। 

মুন, আন্টিকে বলিও নতুন কিছু রান্না করে আমাদের ইনভাইট করতে। এই পিচ্চি, তোকে আর পিচ্চি বলে খ্যাপানো হয়নারে মামা, সেই দিনগুলো আর ফিরে আসবে না এটা ভাবতেই চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে। এখন আমার চারপাশে শুধুই স্মৃতি। স্মৃতিকাতরতা আমার জীবন থেকে কখনোই ছুটি নিচ্ছে না। 

তোরা তো আছিস বেশ, একসঙ্গে। আমি সবার থেকে দূরে। জীবনের কিছু বছর আয়ুর বিনিময়ে যদি স্কুলের কিছু সময় ফিরে আসত! ঝাপসা চোখে আর কিছু স্পষ্ট দেখছি না রে। ভালো থাক তোরা সবাই।

হীরা
কুড়িগ্রাম। 

প্রিয় ভালোবাসা 

৩ জুন ১৯৭৮। সম্ভবত সেদিন আষাঢ়ের ১৮ তারিখ ছিল। দিনপঞ্জির হিসাবে বর্ষাকাল। সেদিন অবশ্য বৃষ্টি ছিল না। অথচ তুমি এলে বৃষ্টির স্নিগ্ধতা নিয়ে। তোমার আগমনের শীতল পরশ ছুঁয়ে দিয়ে গেল সবাইকে। কত প্রিয় ছিলে তোমার বাড়িতে। সবার নয়নের মণি। মনে আছে মা, তোমার বাবার সেদিনের কান্না। এখনো মনে পড়লে চোখ ছলছল করে ওঠে তোমার।

সেদিন সকালে ঘুমিয়েছিলে তুমি। ঘুম ভাঙল উষ্ণ ছোঁয়ায়। যখন চোখ মেলে তাকালে, তোমার মায়ের মুখ তোমার মুখের ওপরে। তার চোখের জলে তোমার মুখ ভিজে গিয়েছিল। গোলাপের পাপড়িতে তোমার লেখা নামে প্রায়ই তাকিয়ে থাকতাম আমি। আবার এ বাড়িরও প্রতিটি মানুষকে ভালোবাসায় জড়িয়ে রেখেছ তুমি। নতুন গল্প, সুর, সুখস্মৃতির জন্মদায়িনী তুমি। যে মানুষকে ভালোবেসে একসঙ্গে থেকেছ, অপরিমেয় সম্মান, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা পেয়েছ তার কাছে। আজ একচল্লিশ বছর পার হয়েছে। তোমার প্রিয় অনেকেই হারিয়ে গেছে না–ফেরার দেশে। তোমার সবচেয়ে কাছের প্রিয়জন চলে গেল অবশেষে। যাওয়ার সময় বলে গেল, ভুল হলে আমাকে ক্ষমা কোরো। আর তোমার তিনজন সোনার ছেলে রেখে গেলাম। তোমাদের চোখের পানিতে সেদিন শুদ্ধ হয়েছিল সব। একচল্লিশ বছর পর, তোমার প্রতিচ্ছবিগুলো তোমার আঙুল ধরে বলে, বলো তো, ‘নোটন নোটন পায়রাগুলি’, ‘ঐ দেখা যায় তালগাছ’, ‘আয় আয় চাঁদ মামা’। তুমি বলতে থাকো

 আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা...

 চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা...

আর নিষ্পাপ দেবশিশু তোমার বুকে পরম মমতায় ঘুমিয়ে যায়। সত্যিই এতগুলো স্বর্গীয় মুখ একসঙ্গে দেখার সৌভাগ্য সবার হয় না।

ডা. এন এ এম আবুল বাশার 
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, ঢাকা।