হ্যাকারের কবজায় সাত দিন

>জীবনের অনেক ঘটনাই রোমাঞ্চকর উপন্যাসকেও হার মানায়। আবার জীবনযাপনের কিছু ঘটনা ছুঁয়ে যায় হৃদয়, স্মৃতিতে গেঁথে থাকে আজীবন। বাস্তবের রুদ্ধশ্বাস কাহিনি ও জীবন যেমন বিভাগে ছুটির দিনে প্রতি সপ্তাহেই পাঠকের এ ধরনের লেখা তুলে ধরে। ৪ নভেম্বর প্রথম আলোর ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ছুটির দিনের এ দুটি বিভাগে পাঠকের বিশেষ লেখা আহ্বান করা হয়েছিল। তাতে সাড়া দিয়ে প্রচুর লেখা পাঠিয়েছেন পাঠকেরা। সেসব থেকে বাছাই করা লেখা নিয়ে সাজানো হয়েছে এবারের ছুটির দিনে।
এলিজা বিনতে এলাহী
এলিজা বিনতে এলাহী

জুলাই, ২০১৯। দিনটি কখনোই ভুলব না। তাৎক্ষণিক একটি ঘটনা আমার কর্মচাঞ্চল্য, উদ্দীপনা, উৎসাহ, বাধাহীন ভ্রমণ সবকিছুতেই খুব ভয়ংকর প্রভাব ফেলেছিল। সেদিন আনুমানিক রাত নয়টা। আমি কিছুতেই আমার ফেসবুক, মেসেঞ্জার খুলতে (লগ–ইন) পারছিলাম না।

বেশ কয়েকবার চেষ্টা করলাম, ফলাফল একই। আচমকা একটি খুদে বার্তা আমার মুঠোফোনে ভেসে উঠল, ‘আমি হ্যাকার, আপনার ফেসবুক ও মেসেঞ্জার আমার দখলে। আমার কথা যদি আপনি শোনেন, তাহলে কিছু হবে না। কিন্তু আমার কথা না শুনলে আপনার ক্ষতি হবে।’ এই কথাগুলো সে লিখল হোয়াটসঅ্যাপে। আমি যশোরে রেডক্রসের গেস্টহাউসে আমার রুমে একা বসে ভয়ে তাকিয়ে আছি খুদে বার্তাটির দিকে। ৬৪ জেলা ভ্রমণের শেষ ৯ জেলা ভ্রমণ করতে তখন যশোরে অবস্থান করছিলাম। সঙ্গে পরিবারের কেউ নেই, পাশের ঘরে আমার ভ্রমণ দলের দুই সদস্য। মুঠোফোন সচল থাকার পরও নিজেকে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন মনে হচ্ছিল, একা লাগছিল। খানিক বসে থেকে পাশের ঘরে গিয়ে দলের দুজনকে সব জানালাম। সেই হ্যাকার একের পর এক খুদে বার্তা পাঠিয়ে যাচ্ছে, আমি হুমকিপূর্ণ মেসেজগুলো দেখছি, কিন্তু কোনো উত্তর দিচ্ছি না। তারপর সে ফোন করতে লাগল। ফোন ক্রমাগত বেজে যাচ্ছে, কিন্তু আমি ধরছি না দেখে হ্যাকার আরও রেগে গিয়ে জঘন্য ভাষায় বার্তা পাঠাতে লাগল।

আঁতিপাঁতি করে খুঁজছি, কাকে ফোন দেব, কী পদক্ষেপ নেব, কী করা উচিত। নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু অজানা আশঙ্কায় খুব চঞ্চল হয়ে উঠছিলাম। অবশেষে ক্রমাগত রিং হওয়ার কারণে, আমার দলের এক সদস্য সেই ফোন রিসিভ করল। তখন হ্যাকার ৫০ হাজার টাকা দাবি করে বলল, কালকের মধ্যে টাকা না পেলে আমার নগ্ন ছবি বানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করে দেবে। ততক্ষণে সে আমার মেসেঞ্জার থেকে নানান আজেবাজে পর্ন সাইটের লিংক আমার বন্ধুদের পাঠাতে লাগল। কেউ কেউ মুঠোফোনে সেই কথা আমাকে জানাল। আবার কেউ কেউ আমি ভেবেই তার সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিল, যা আমি পরে বুঝেছি।

পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে, আমি মুঠোফোনে বেশ কয়েকজনের কাছে সাহায্য চাইলাম, যেন আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক হওয়ার কথাটা তারা নিজের টাইমলাইনে লিখে পোস্ট করে। প্রায় ১৫ থেকে ২০ জনকে বলেছি কথাটা। আমি নিশ্চিত হলাম এই ভেবে, এখন আর হ্যাকার কাউকে বিরক্ত করবে না বা বিপদে ফেলবে না। কিন্তু তারপরও ফোন আসতে থাকল। আবারও সবাইকে অনুরোধ করলাম। তিনজন আমার হয়ে স্ট্যাটাস দিল।

.
.

আমি ঢাকায় ফেরার প্রস্তুতি নিলাম সে রাতেই। বাসে উঠতে যাব, এমন সময় বাসা থেকে জানানো হলো, আমার প্রোফাইলে কিছু বাজে ছবি পোস্ট করা হয়েছে। এরপর আবার ফোন আর বার্তা। এবার শুভাকাঙ্ক্ষীদের। বন্ধুরা খবর নিচ্ছে, কেউ সাবধান করছে, সান্ত্বনা দিচ্ছে, কেউবা জিজ্ঞাসা করছে, ছবিগুলো আমারই কি না। আমি উত্তর দেব, না ভয় পাব, না মন খারাপ করব, অথবা হতাশ হব, কাঁদব, উদ্বিগ্ন হব, চিন্তিত হব, লজ্জা পাব—কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আমার বন্ধু-সংযুক্তি একেবারে কম নয়। সেখানে আমার ছাত্রছাত্রী, আমার ছেলের বন্ধুরা, আত্মীয়স্বজন, অফিসের সহকর্মী, নানান দেশের শিক্ষকেরা আছেন।

বাসে বসে মনে হচ্ছিল, কখন ঢাকা পৌঁছাব। প্রতিটা সেকেন্ড এত দীর্ঘ, সেদিন উপলব্ধি করেছি। একদিকে হ্যাকারের পাঠানো বার্তা, অন্যদিকে শুভাকাঙ্ক্ষীদের জবাবদিহি করতে হচ্ছে। কারণ, আমার মেসেঞ্জার থেকে যাঁদের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করা হয়েছে, তাঁদের কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছিলেন, আপনার সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে নিজের অ্যাকাউন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হলো। শুধু মনে হচ্ছিল, এই বিপদ থেকে কীভাবে রক্ষা পাব।

নির্ঘুম রাত পার করে ভোরে এসে নামলাম ঢাকায়। সাংবাদিক বন্ধু সোহেলীর সহায়তায় গেলাম ঢাকার সাইবার ক্রাইম বিভাগে, তারা অভিযোগ নিল অত্যন্ত সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব নিয়ে। ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ফিরে পাওয়ার নানা চেষ্টা করতে থাকলেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। কারণ, অ্যাকাউন্ট ফিরে পেলেই, হ্যাকারের কাছ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। কিন্তু হ্যাকারের ক্রমাগত হুমকি আর জঘন্য ভাষার গালাগাল আমাকে মানসিকভাবে দুর্বল করে তুলছিল। ধীরে ধীরে খবর পেতে থাকলাম, আমার অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সে আরও প্রায় ৪০ জনের অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে টাকা চাইছে, যাদের মধ্যে বেশির ভাগই আমার শিক্ষার্থী। নিজেকে অপরাধী মনে হতে থাকল।

সাইবার ক্রাইম কর্মকর্তারা আমাকে বলে দিলেন, ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ফিরে পাওয়া অবধি হ্যাকারকে শান্ত রাখুন টাকা জোগাড় করছি বলে। আমিও তাই করতে থাকলাম। কিন্তু দিনরাত হ্যাকার হুমকি দেওয়া বন্ধ রাখেনি। সে রাত দুইটা–তিনটার সময়ও বার্তা পাঠাতে থাকল। সকালে উঠে সাইবার ক্রাইম অফিসে যেতাম, সন্ধ্যায় সেখান থেকে আসতাম। প্রতিদিনই মনে হতো, এই বুঝি ফেরত পাব অ্যাকাউন্ট আর মুক্তি পাব হ্যাকারের কাছ থেকে। কিসের ভ্রমণ, কিসের মিশন, পুরো সাত দিন হ্যাকার সামলানো আর শুভাকাঙ্ক্ষীদের উত্তর দেওয়া।

অবশেষে ঠিক হলো, টাকা মোবাইল অ্যাপে পাঠানো হবে। সে সময় হ্যাকারকে শনাক্ত করা হবে। পুরোপুরি সিনেমার কায়দায় আমি সাইবার ক্রাইম অফিসে বসে মোবাইল অ্যাপে টাকা পাঠালাম। টাকা যার কাছে গেল, সেই নম্বরের লোককে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকল। কিন্তু হ্যাকারকে শনাক্ত করা যায়নি, উপরন্তু সে বুঝে ফেলেছে, আমি পুলিশের সহায়তা নিয়েছি। আর যায় কোথায়! সে আবারও আমার প্রোফাইল থেকে ছবি প্রকাশ করল। যে বন্ধুদের স্মৃতি মলিন হয়ে গিয়েছিল, তাঁদের স্মৃতি আবারও জাগ্রত হলো, পুনরায় আমার ছবি দেখে। হ্যাকার স্ট্যাটাস দিয়েছিল ‘আমি একটু ফেমাস হতে চাই’। একজন তো লিখে পাঠাল ‘আপা, এভাবে কি ফেমাস হওয়া যায়?’ সেই বন্ধুকে আমি উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি।

আমি পুলিশের সহায়তা নিয়েছি দেখে হ্যাকার আমাকে বার্তা পাঠানো বন্ধ করে দিল। শেষে ফেসবুকের কাছে আবেদন করে অ্যাকাউন্ট ফেরত পেয়েছি। এক মাস পর আমি আবার ভ্রমণে বের হয়েছি। কিন্তু পুরো বিষয়টা নিয়ে ভেতরের ভয় আর অস্বস্তি কাটেনি অনেক দিন। এমনকি এই লেখা লেখার সময়ও আমি অস্বস্তি নিয়ে লিখছি। কারণ, আমি হ্যাকারের বিরুদ্ধে মামলা করেছি। মামলা করার কারণেই পুলিশ এই বিষয়টা নিয়ে এগোতে পেরেছে। হ্যাকার ধরা পড়েছে। এখন তার ভাই আর বাবা আমাকে ক্রমাগত ফোন করছে মামলা উঠিয়ে নেওয়ার জন্য।

সেই সাত দিন আমি এখনো ভুলতে পারি না। পুরো বাংলাদেশ ভ্রমণের ভিন্ন এক আমেজ থেকে হ্যাকার আমাকে সাত দিনের জন্য ভয়ংকর একটি জায়গায় বন্দী করে রেখেছিল মানসিকভাবে। সে সময় আমি বুঝেছি, যে মেয়েদের সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে, তাদের ট্রমা কত ভয়াবহ।

এলিজা বিনতে এলাহী : পর্যটক, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।