মৃত্যুযাত্রা থেকে ফিরে

>জীবনের অনেক ঘটনাই রোমাঞ্চকর উপন্যাসকেও হার মানায়। আবার জীবনযাপনের কিছু ঘটনা ছুঁয়ে যায় হৃদয়, স্মৃতিতে গেঁথে থাকে আজীবন। বাস্তবের রুদ্ধশ্বাস কাহিনি ও জীবন যেমন বিভাগে ছুটির দিনে প্রতি সপ্তাহেই পাঠকের এ ধরনের লেখা তুলে ধরে। ৪ নভেম্বর প্রথম আলোর ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ছুটির দিনের এ দুটি বিভাগে পাঠকের বিশেষ লেখা আহ্বান করা হয়েছিল। তাতে সাড়া দিয়ে প্রচুর লেখা পাঠিয়েছেন পাঠকেরা। সেসব থেকে বাছাই করা লেখা নিয়ে সাজানো হয়েছে এবারের ছুটির দিনে।
বিল্লাল আহমদ
বিল্লাল আহমদ

২০১৮ সালের ডিসেম্বর। ইতালি যাওয়ার জন্য দুই ভাতিজা আবদুল আজিজ, লিটন শিকদার ও ভাগনে আহমদ হোসেন এবং আমি ভারতের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলাম। মনে তখন অজানা সুখ। পাশাপাশি নানান চিন্তাও ছিল। তবে আমরা একই পরিবারের চার সদস্য থাকায় যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করার মনোবল ছিল।

এর আগে আমরা সিলেট নগরের জিন্দাবাজার এলাকার নিউ এহিয়া ওভারসিজ নামের একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে চুক্তি করেছিলাম। জনপ্রতি ৯ লাখ টাকায় ভারত থেকে সরাসরি ইতালি পৌঁছে দেওয়ার কথা দিয়েছিলেন এজেন্সির পরিচালক এনামূল হক। ইতালি পৌঁছার পর দেশেই টাকা পরিশোধের শর্তে আমরা পাড়ি দিয়েছিলাম।

যাই হোক, ১৫ ডিসেম্বরের দিকে ভারতের শিলংয়ে পৌঁছালাম। পরে সেখান থেকে কলকাতা, দিল্লি হয়ে মুম্বাই পৌঁছালাম। মুম্বাইয়ে আমরা প্রায় তিন দিন ছিলাম। সেখানে থাকা এজেন্সির লোকজন একটি উড়োজাহাজে তুলে দিল। আমরা গিয়ে নামলাম শ্রীলঙ্কার একটি বিমানবন্দরে। শ্রীলঙ্কায় তিন দিন থাকার পর ইতালি পৌঁছানোর কথা বলে উড়োজাহাজে কাতার হয়ে তিউনিসিয়া বিমানবন্দরে গেল। সেখানে প্রায় ২১ ঘণ্টা কাটালাম। পরিচয় হলো সিলেটের আরও তিন তরুণের সঙ্গে। তাঁরাও ইতালি যাওয়ার জন্য একটি এজেন্সির মাধ্যমে এসেছেন। তাঁদের পেয়ে মনে মনে আরও আশ্বস্ত হলাম। আমরা সাতজন একসঙ্গেই বিমানবন্দর ঘুরে দেখলাম। তিউনিসিয়া বিমানবন্দর থেকে ফের বিমানে করে লিবিয়ার মিসরাতা বিমানবন্দরে পৌঁছালাম।

 বিমানবন্দরে ১০-১২ জন অস্ত্রধারী আমাদের ঘিরে ধরল। প্রথম দিকে তাঁদের সে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মনে হলেও, একটু পরই বুঝলাম অস্ত্রধারীরা আমাদের জিম্মি করে ফেলেছে। তারা একটি গাড়িতে করে মিসরাতার একটি মরুভূমিতে নিয়ে গেল। পরে সেখান থেকে ত্রিপোলি, জুয়ারায় ক্যাম্পে দিন কাটতে থাকল। এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত বর্বর। গাড়ির ভ্যানের পেছনে একজনের ওপর আরেকজনকে তুলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মরুভূমিতে নিয়ে যাওয়া হতো। এ সময় খাবার তো দূরের কথা পানিও পাওয়া যেত না। ক্যাম্পগুলো বদল হওয়ার সঙ্গে নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি পেত। এক ফোঁটা পানির জন্য হা করে তাকিয়ে থাকতে হয়েছে। ছোট ঘরে ১০ গুণের অধিক মানুষ থাকতে হয়েছে। জায়গার অভাবে বসে বসে ঘুমাতে হয়েছে। লিবিয়ার জুয়ারা ক্যাম্পে থাকা অবস্থায় চারটি ছোট কক্ষে আমাদের মোট ৪২ জনকে থাকতে হয়েছিল। পাঁচ লিটারের দুটি পানির বোতল দেওয়া হতো। সে সময় সপ্তাহে ১২ কেজি চাল, কিছু ডাল, পেঁয়াজ, সামান্য তেল দেওয়া হতো। সেগুলো ৪২ জনে মিলে এক সপ্তাহ খেতে হয়েছে। পানি যাতে কম খাওয়া হয়ে সে জন্য চায়ের কাপে পানি খেতাম। আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল মুঠোফোন সঙ্গে লুকিয়ে রাখা ডলার, টাকাপয়সা। খাওয়ার জন্য বাড়িতে ফোন করে দালাল ধরে টাকা আনতাম। সেগুলো আমাদের হাতে আসার পর কয়েক গুণ কমে যেত। বাড়ি থেকে ১০ হাজার টাকা পাঠালে আমাদের হাতে আসতে আসতে এক হাজার টাকা হতো। আমরা এক পরিবারের চার সদস্য তখন একে অপরকে সান্ত্বনা দিতাম। মনোবল বৃদ্ধি করার চেষ্টা করতাম। আমি সবার বড়, তাই সবাই আমার কাছে আশার বাণী শুনতে চাইত।

তিউনিসিয়া থেকে এভাবে অনিশ্চিত যাত্রায় সাগর পাড়ি দিতে চান অনেকে
তিউনিসিয়া থেকে এভাবে অনিশ্চিত যাত্রায় সাগর পাড়ি দিতে চান অনেকে

একদিন জুয়ারা ক্যাম্পে থাকা অবস্থায় এক লিটার দুধ কিনতে আমাদের চাপ দিচ্ছিল এক অস্ত্রধারী। এক লিটার দুধের জন্য সে ১০০ ডলার চাচ্ছে। ক্যাম্পে থাকা আমাদের ৪২ জনের কাছে কোনো ডলার ছিল না। তাই আমরা দুধের প্যাকেট নিচ্ছিলাম না। যার কারণে ওই দালাল পানির ট্যাংকে পেট্রল ঢেলে দিয়েছিল। সে পানি খেয়ে ক্যাম্পে থাকা ৪২ জনেরই ডায়রিয়া হয়ে গিয়েছিল। তবে কোনো ওষুধ ছাড়াই সৃষ্টিকর্তার অপার দয়ায় আমরা সুস্থ হয়েছিলাম। ক্যাম্পগুলোতে রুবেল, নোমান, গুডলাক, মোয়াজ নামে কয়েকজনকর ডাকাডাকি করতে শুনেছি। এর মধ্যে রুবেল ও নোমান বাঙালি, বাকিরা লিবিয়ার নাগরিক। দেশ থেকে টাকা এনে দিতে না পারায় একদিন রাতে ঘরের মধ্যে ঢুকে ১০-১২ জন অস্ত্রধারী আমােদর বেধড়ক পিটুনি শুরু করে। ভারী অস্ত্রের আঘাতে আমার মাথা ফেটে যায়। তারপরও তাদের দয়া হয়নি। এমন নির্যাতনের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে ক্যাম্পে থাকা মুঠোফোনে দেশে ফোন দিয়ে কাঁদতাম, বলতাম নির্যাতনের কথা।

ক্যাম্পগুলোতে প্রায় চার মাস কাটানোর সময় বিভিন্ন জায়গা থেকে জড়ো হওয়া প্রায় ১৪০ জন ইতালি যাত্রী একত্র হয়েছিল। এরপর মে মাসের ৮ তারিখ প্রথম রোজা রেখে দ্বিতীয় রোজার সাহ্‌রির সময় আমাদের ইতালি নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হলো। জুয়ারা ক্যাম্প থেকে অস্ত্রধারীরা আমাদের সার বেঁধে মরুভূমিতে পায়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যায়। অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে প্রথমে ট্রলারে করে, পরে সেখান থেকে অতিরিক্ত যাত্রী দিয়ে ছোট নৌকায় তোলা হয়। নৌকায় উঠতেই ডুবতে শুরু করে। মাঝনদীতেই ডুবে যায় ৮০ জন যাত্রী বোঝাই নৌকাটি। সমুদ্রের লোনা পানি নাকেমুখে ঢুকে প্রথম দফাতেই বেশ কয়েকজন গভীর সাগরে তলিয়ে যায়। আমিসহ আমার দুই ভাতিজা এবং এক ভাগনে নৌকার ভাঙা অংশ ধরে সাঁতার দিচ্ছিলাম। রাতের অন্ধকারে আমি তাদের নাম ধরে ডাকছিলাম, নৌকা ধরে রাখতে বলছিলাম। তবে ঠান্ডা পানিতে টিকে থাকতে কষ্ট  হচ্ছিল। একপর্যায়ে ভাতিজা আবদুল আজিজ ও লিটন শিকদারের সাড়া পাচ্ছিলাম না। তারা সমুদ্রের গভীর নোনাজলে হারিয়ে গেল। পরে ভোররাতে ভাগনে আহমদ হোসেনকে হারিয়েছি। ১১ মে আমিসহ আরও ১৬ জনকে উদ্ধার করে তিউনিসিয়ার মাছ শিকারিরা। পরে ২৪ মে সরকারের মাধ্যমে দেশে ফিরি।

দেশে ফিরে চিকিৎসা নিয়েছি। এখনো লিবিয়ার সেই নির্যাতনের কথা ভুলতে পারিনি। হঠাৎ রাতে ঘুম ভেঙে যায়। আমার দুই ভাতিজা এবং ভাগনের কথা মনে হলে আমি স্বাভাবিক থাকতে পারি না। তারপরও স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করি। এনামূল হকের নামে মামলা করা হয়েছে। র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তারও হয়েছে। এখন হুমকি–ধমকি দিয়ে মামলা আপস–মীমাংসা করার কথা বলা হচ্ছে।

কৃষিজীবী, ফেঞ্চুগঞ্জ, সিলেট।