তিনাপ সাইতারের দুঃখ

>
আবু সাঈদ
আবু সাঈদ
জীবনের অনেক ঘটনাই রোমাঞ্চকর উপন্যাসকেও হার মানায়। আবার জীবনযাপনের কিছু ঘটনা ছুঁয়ে যায় হৃদয়, স্মৃতিতে গেঁথে থাকে আজীবন। বাস্তবের রুদ্ধশ্বাস কাহিনি ও জীবন যেমন বিভাগে ছুটির দিনে প্রতি সপ্তাহেই পাঠকের এ ধরনের লেখা তুলে ধরে। ৪ নভেম্বর প্রথম আলোর ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ছুটির দিনের এ দুটি বিভাগে পাঠকের বিশেষ লেখা আহ্বান করা হয়েছিল। তাতে সাড়া দিয়ে প্রচুর লেখা পাঠিয়েছেন পাঠকেরা। সেসব থেকে বাছাই করা লেখা নিয়ে সাজানো হয়েছে এবারের ছুটির দিনে।

চলতি বছরের ২৯ জুন। আমরা ছয়জন গিয়েছিলাম তিনাপ সাইতার (ঝরনা) দেখতে। বান্দরবানের রুমা আর রোয়াংছড়ি উপজেলার সীমানায় এই ঝরনা মুহূর্তেই মন কাড়ল। দুর্গম পথ মাড়িয়ে এমন একটি রোমাঞ্চের প্রত্যাশা ছিল সবার।

নেমে পড়লাম ঝরনার জলে। ভিজতে ভিজতেই আচমকা আকাশটা মেঘলা হয়ে এল। সূর্য ঢাকা পড়ল কালো মেঘে। পাহাড়ি প্রকৃতি ক্রমেই অন্ধকার হয়ে এল। ঝড় আসন্ন দেখে তড়িঘড়ি করে আমরা ফেরার প্রস্তুতি নিলাম। প্রস্তুতি নিতে না–নিতেই প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হলো। সব যেন ঘটছিল অতি দ্রুত।

আমরা ভিজতে ভিজতেই ঝিরিপথ পার হচ্ছিলাম। একজন আরেকজনকে সাহায্য করছিলাম। এভাবে কিছুদূর যাওয়ার পর আমরা থামলাম। এবার পাহাড়ে উঠতে হবে। পাহাড় বেয়ে উঠতে হলে পানি পেরিয়ে এপার থেকে ওপারে যেতে হবে। আমরা একে একে পার হচ্ছিলাম। এদিকে ঝিরিপথের হাঁটুপানি ততক্ষণে কোমরের ওপরে উঠেছে। সঙ্গে প্রচণ্ড স্রোত। বিভিন্ন আকারের পাথরগুলো স্রোতে নড়বড়ে হয়ে গেছে। কখনো কখনো পায়ের পাড়ায় পাথর সরে যাচ্ছিল। খুব সতর্কতার সঙ্গে এগোচ্ছিলাম আমরা। ঠিক তখনই আচমকা স্রোতের ধাক্কায় বন্ধু আশিক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধপাস করে পানিতে পড়ে গেল। সেই বিস্ময় কাটতে না–কাটতেই পড়ে গেলাম আমিও।

আমরা দুজনে স্রোতের তোড়ে ভেসে যাচ্ছি। আঁকড়ে ধরার মতো কিছুই পাচ্ছি না। ভেসে যাচ্ছি তো যাচ্ছিই। আরও কিছুদূর ভেসে যাওয়ার পর একটা হাত টান মেরে আমাকে ধরল। চোখ মেলে দেখি আশিক। লক্ষ করলাম, সে কোনোমতে একটা বড় পাথর ধরে স্রোতের বিপরীতে আটকে আছে। কিন্তু আমাকে ধরতে গিয়ে পাথরটা ধরে রাখতে পারেনি। আশিক আর আমি আবারও ভাসতে থাকলাম। মনের ভেতর হাজারও সংশয়—এবার মনে হচ্ছিল আর বুঝি বাঁচব না।

দুর্ঘটনায় পড়ার আগে তিনাপ ঝরনায় দলের ছয় সদস্য। ছবি: সংগৃহীত
দুর্ঘটনায় পড়ার আগে তিনাপ ঝরনায় দলের ছয় সদস্য। ছবি: সংগৃহীত

কিন্তু না, ভাসতে ভাসতেই কীভাবে যেন পাহাড় থেকে ঢলে পড়া একটা বাঁশ ধরে ফেললাম। কিন্তু স্রোতের এত তীব্রতা, বাঁশটা ঠিকমতো ধরে রাখতেও পারছিলাম না। পুরো শরীর পানির ওপরে কোনোমতে ভেসে আছে। তবু প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে ধরে রেখেছিলাম। কেননা, সেই বাঁশটাই বাঁচার শেষ অবলম্বন। হঠাৎ ভেসে আসা গাছের গুঁড়ি লাগল আমার হাতে। বাঁ হাতে জোরে আঘাত পেলাম। বাঁশ থেকে বাঁ হাত ছুটে গেল।

মনে হলো এই বুঝি শেষ। না, তখনো শক্ত করে ডান হাত দিয়ে ধরে ছিলাম বাঁশ। গাছের গুঁড়ির ধাক্কায় কিছুটা পাড়ের দিকেও এগিয়ে গেলাম। তারপর ধীরে ধীরে বাঁশটা ধরে এগোলাম পাড়ের দিকে। একটা সময় পাড়ে উঠেও পড়লাম। বাঁ হাত দিয়ে তখন রক্ত ঝরছে। এতক্ষণ বাঁচার চেষ্টায় শরীরটাও অবসাদ হয়ে পড়েছে। নড়তে পারছিলাম না। বেশ কিছুক্ষণ পড়ে রইলাম পাড়ে।

তারপর বন্ধুদের খোঁজ করতে শুরু করলাম। কাছেই দেখলাম আশিক একটি আধা ভাঙা বাঁশ ধরে পানিতে ভাসছে। এগিয়ে গিয়ে আশিককে উদ্ধার করলাম। তারপর বাকিদের খুঁজতে থাকলাম। একটা সময় সবার দেখা পেলাম। দুজন একটি দ্বীপের মতো জায়গায় দাঁড়িয়ে। বাকি দুজনের একজন বড় এক পাথরে দাঁড়িয়ে, পাথরটির চারপাশজুড়ে স্রোত বইছে। আরেকজন পাড়ের কাছাকাছি দুই পাথরের কাছে। ওদিকে আমাদের গাইডকে দেখলাম বাঁশ কাটছে সবাইকে উদ্ধার করার জন্য। কিন্তু আমরা সবাইকে উদ্ধার করতে পারলাম না। সেই স্রোতেই আমরা দুজন বন্ধুকে হারালাম। তিনাপ সাইতারের সেই দুঃখ আজও তাড়া করে ফেরে।

শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ।