প্রায়শ্চিত্ত

>
মহিদুর রহমান
মহিদুর রহমান
জীবনের অনেক ঘটনাই রোমাঞ্চকর উপন্যাসকেও হার মানায়। আবার জীবনযাপনের কিছু ঘটনা ছুঁয়ে যায় হৃদয়, স্মৃতিতে গেঁথে থাকে আজীবন। বাস্তবের রুদ্ধশ্বাস কাহিনি ও জীবন যেমন বিভাগে ছুটির দিনে প্রতি সপ্তাহেই পাঠকের এ ধরনের লেখা তুলে ধরে। ৪ নভেম্বর প্রথম আলোর ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ছুটির দিনের এ দুটি বিভাগে পাঠকের বিশেষ লেখা আহ্বান করা হয়েছিল। তাতে সাড়া দিয়ে প্রচুর লেখা পাঠিয়েছেন পাঠকেরা। সেসব থেকে বাছাই করা লেখা নিয়ে সাজানো হয়েছে এবারের ছুটির দিনে।

ঘড়ির কাঁটা তখন বেলা দুইটার কিছু ওপরে। এ সময় সিলেট শহরের স্টেডিয়াম মার্কেটের সামনে খুব জটলা থাকে। যানজট। পথচারীদের ভিড়। সেই ভিড় ঠেলে কবি নজরুল অডিটরিয়ামের সামনে দাঁড়াতেই পেছন দিক থেকে একজন পুলিশ সদস্য এসে আমার হাতের কবজি ধরে হ্যাঁচকা একটা টান দিয়ে কোনো ভূমিকা না করেই বলে, আমার সঙ্গে চলেন।

আমি এমন অতর্কিতে পুলিশ দেখে হতচকিত হয়ে যাই। চোখ কপালে তুলে পুলিশের চোখের ওপর চোখ রেখে বলি, কী ব্যাপার? আমি কী করেছি?

আপনি আসুন।

কেন আসব? আর কোথায় আসব?

আমার সঙ্গে আসুন। গাড়িতে।

কোনো কিছু না বুঝেই হাঁটতে থাকি। পুলিশ তখনো আমার হাতের কবজি ছাড়েনি। ততক্ষণে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। নিজে কোনো অপরাধ করেছি কি না, এসব ভাবনায় কোথায় যেন তলিয়ে যাই। আমি গাড়ির পাশে যেতেই পুলিশ আমাকে ইশারায় গাড়িতে উঠতে বলে। আমি কিছু ইতস্তত করে গাড়ির ভেতরে চোখ রাখতেই দেখি এক নারী বসে আছেন। খুব সাজগোজ করা। তাঁকে যেন অপরূপ লাগছে। প্রথম দেখাতে তাঁর বয়স অধিক কি অল্প, ঠিক বোঝা যায়নি। তবে তাঁর চোখের ভাষায় কেমন একটা মানবিক অনুভূতি অস্ফুটভাবে ফুটে উঠেছে মনে হলো। আমি তখন পুলিশকে বলি, আমার সঙ্গে আমার সহপাঠী এনায়েত আছে, তাকে সঙ্গে নিই?

আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে গাড়িতে বসা নারী বললেন, না না, আর কোনো লোক এখানে বসতে পারবে না। আপনি ওঠেন।

তাঁর পাশের সিটটি দেখিয়ে বললেন, এখানে বসুন।

আমি নিরুপায় হয়ে জড়সড় হয়ে বসতে বাধ্য হলাম। নারীটি ড্রাইভারকে বললেন, ড্রাইভার, গাড়ি ছাড়েন।

গাড়িতে কয়েদির মতো আমি বসে আছি। কিছুই বুঝতে পারছি না। সামনের পানে গাড়ি চলছে। ততক্ষণে আমার মাথা–কপাল ঘেমে জল জমে গেছে, শীতের সকালে দূর্বাঘাসে যেমন শিশির জমে। গাড়ির কাচ-জানালা বন্ধ। স্বচ্ছ কাচের ভেতর দিয়ে হঠাৎ বাইরে তাকালে চারপাশ কেমন ঝাপসা মনে হলো। মহিলাটি আমাকে যেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছেন। তাঁর কপালে টিপ। হাতে কয়েক গাছি চুড়ি। পরনে শাড়ি। তাঁর কী একটা মায়াবী চাহনি আমাকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও আবিষ্ট করে রাখে।

গাড়ি চলছে সামনের পানে। গাড়ির গতি মন্থর। মহিলাটি আমার উদ্দেশে বললেন, আমাকে চিনতে পেরেছেন?

না, কে আপনি?

ভালো করে দেখেন তো আমাকে চিনতে পারেন কি না?

না, আমি আপনাকে চিনি না? কী চান আপনি?

আমি তখন কিছুটা সাহসী হয়ে উঠি। মনের জোর কী কারণে জানি বেড়ে যায়। তখন মনে মনে ভাবি, আমি একটা টগবগে তরুণ, কেন ভয় পাব?

মহিলা তখন তাঁর কণ্ঠটা একটু নামিয়ে বললেন, আপনি আড়ংয়ে চাকরি করতেন না? ঢাকায়?

জি, করতাম। কেন?

মনে করে দেখেন তো, আপনার সঙ্গে কেউ তখন দুর্ব্যবহার করেছিল কি না?

আমার মনে নেই। কতজনই তো কত রকম ব্যবহার করেছে।

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

আপনাকে কোনো মহিলা কি কখনো হাতের ব্যাগ ছুড়ে মেরেছিল?

আমি তখন কিছুটা অবাক হই। তখনই তিন বছর আগের একটা ঘটনা আমার মনে পড়ে। খুব বাজে একটা ঘটনা।

তখন আমি ঢাকায় আড়ংয়ের সেলসম্যান। একদিন এক মহিলা পর্দা কিনতে আসেন। তাঁর ৪৪টি পর্দার প্রয়োজন ছিল। আমি তাঁকে ১৩টি পর্দা দিয়ে বলেছিলাম, এক সপ্তাহ পরে আসেন।

এক সপ্তাহ পরে এলে তাঁকে পর্দা দিতে পারিনি। পরের সপ্তাহে আসতে বলি। এভাবে তিনটি তারিখ করতে হয়েছিল। শেষমেশ মহিলাটি আমার ওপর চড়াও হয়েছিলেন। হাতের ব্যাগ ছুড়ে আমার মুখের ওপর মেরেছিলেন আর আমি তখন চোখে খুব আঘাত পেয়েছিলাম। তার পরের দিনই চাকরি ছেড়ে  দিয়েছিলাম।

আমার চোখের সামনে তখন সেদিনের সেই নারীমুখটি ভেসে উঠল। এ তো দেখছি সেই মহিলা! মহিলাটি তখন বললেন, আপনি রাগ করবেন না ভাই। সেদিন আমার মাথা ঠিক ছিল না। আমার বিয়ের তারিখ ঠিকঠাক ছিল তো!

না, এসব ভুলে গিয়েছিলাম।

আপনি আমাকে মাফ করবেন। সেদিনের সেই আচরণের জন্য আমি সত্যি দুঃখিত। সরি ভাই।

মহিলাটি আমাকে একটি কার্ড ধরিয়ে বললেন, এটি রাখুন। আমার স্বামীর কার্ড এটি। আমার স্বামী আপনাদের সিলেটের এএসপি। কখনো কাজে আসতে পারে।

আমি কার্ডটি হাতে নিই। তারপর আরেকটি কার্ড দিয়ে মহিলাটি বললেন, এটি আমার কার্ড। কোনো প্রয়োজন হলে ফোন দেবেন।

আমি তখন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। মৃদু হেসে বললাম, এবার আমাকে যেতে দিন।

তখন একটা কনফেকশনারির সামনে গাড়িটা থামে। কনফেকশনারির নাম বনফুল। মহিলাটি গাড়ি থেকে নেমে থপ থপ করে হেঁটে ভেতরে প্রবেশ করেন আর হাতের ইশারায় আমাকে ভেতরে যাওয়ার জন্য ইঙ্গিত করেন।

আমি তখন মনে মনে বুঝলাম, এবার কিছু একটা খেতে হবে হয়তো!

ব্যবসায়ী, গীর্জাপাড়া, মৌলভীবাজার।