নীল শাড়ি, শাহানা

>
অরুণ কুমার বিশ্বাস
অরুণ কুমার বিশ্বাস
জীবনের অনেক ঘটনাই রোমাঞ্চকর উপন্যাসকেও হার মানায়। আবার জীবনযাপনের কিছু ঘটনা ছুঁয়ে যায় হৃদয়, স্মৃতিতে গেঁথে থাকে আজীবন। বাস্তবের রুদ্ধশ্বাস কাহিনি ও জীবন যেমন বিভাগে ছুটির দিনে প্রতি সপ্তাহেই পাঠকের এ ধরনের লেখা তুলে ধরে। ৪ নভেম্বর প্রথম আলোর ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ছুটির দিনের এ দুটি বিভাগে পাঠকের বিশেষ লেখা আহ্বান করা হয়েছিল। তাতে সাড়া দিয়ে প্রচুর লেখা পাঠিয়েছেন পাঠকেরা। সেসব থেকে বাছাই করা লেখা নিয়ে সাজানো হয়েছে এবারের ছুটির দিনে।

মেয়েটাকে হঠাৎ খুব গম্ভীর মনে হলো। মানে ওর মন খারাপ। বস্তুত, শাহানা এমন মেয়েই নয় যে কিনা মুখ ভার করে রাখতে পারে। ওর ঠোঁটে শুধু হাসি আর আনন্দ। আর শুধু ঠোঁটই বা বলি কেন, শাহানার চোখও হাসে। ওর দুচোখের পাতে অপার আনন্দ খেলা করে।

সে অনেক দিন আগের কথা। শাহানা আমার সহপাঠী শুধু নয়, ভালো বন্ধুও বটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা ইংরেজি সাহিত্যে পড়তাম। শ্রদ্ধেয় কবীর চৌধুরী স্যার যখন বেকেটের ওয়েটিং ফর গোডো পড়াতেন, তাঁর দাঁতের ফাঁক গলে ফসকে বেরিয়ে যেত লাকি আর পোগোর আপাত অর্থহীন কথোপকথন, শাহানা তখন পেছনের সিটে বসে অন্যদের সঙ্গে দিব্যি খুনসুটি করত। অথচ তখনো আমরা জানি না যে নীল শাড়ি পরা ‘টমবয়’ গোছের মেয়েটা কারও প্রেমে পড়েছে। ওর চলাফেরা ও ভাবসাব দেখে মনেই হতো না ও কারও প্রেমে ‘নামতে’ পারে।

 এক ফাঁকে বললাম, আচ্ছা শাহানা, তোমার কি খুব মন খারাপ!

 ‘কেন বলো তো?’ সে আমাকে উল্টো জেরা করে।

 না মানে, তোমার সেই উদাসী উড়ুক্কু মনে যেন আজ মেঘ জমেছে। বন হরিণির সেই অচঞ্চলতা আজ কোথায়। কেসটা কী, একটু খুলে বলবে!

 শাহানা চুপ। কিচ্ছু বলে না সে। যেন নৈঃশব্দ্যের উপাসনা করছে। কিন্তু আমি ঠিক বুঝতে পারি, সামথিং ইজ ভেরি রং উইথ হার। স্পষ্ট দেখতে পাই, ওর মনে বিষাদের ছায়া দোল খায়। পরপর দুটো দিন শাহানাকে আর দেখা যায় না। সে লাপাত্তা। অমন প্রাণচঞ্চল মিষ্টি মেয়েটা হঠাৎ গেল কোথায়!

নিজের উচ্চতা নিয়ে খুব হীনম্মন্যতা ছিল ওর, জানেন। মাত্র পাঁচ ফুট। তবে ও হিল পরত না কখনো। বলত, স্রষ্টা আমাকে যা দিয়েছেন, তাতেই আমার খুশি থাকা উচিত। তবে কেউ তাকে ‘বাটুল’ বললে খুব খেপে যেত শাহানা। প্রায়ই শাড়ি পরত, সঙ্গে রং মিলিয়ে টিপ, কানের দুল। মাটির গয়নার প্রতি খুব আকর্ষণ ছিল ওর। বলত, মাটির মায়া কি সহজে ছাড়া যায়। ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা’! ওর দেশপ্রেম আমাকে আবিষ্ট করে। দেশের প্রতি যার গভীর মায়া, সে কখনো অন্যায় করতে পারে না।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

তৃতীয় দিনেও সে যখন এল না, আমি ও আমরা চিন্তিত হয়ে পড়ি। শাহানা কি তবে কোনো বিপদে পড়েছে! নাকি অন্য কিছু। মেয়েটা চঞ্চল, আবার ভাবুকও। হঠাৎই দেখা যেত শাহানা একা কোথাও গিয়ে মুখ লুকিয়ে কাঁদছে। ওর কষ্টটা ঠিক কিসের, বোঝা মুশকিল। মানুষের একান্ত কিছু অনুভূতি কারও সঙ্গে শেয়ার করা যায় না। উচিতও নয়।

তারপর হঠাৎ একদিন আমরা অন্য এক শাহানাকে দেখতে পাই। সেদিন বিকেলে ক্যাম্পাসে ‘একপশলা’ গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছিল। কলা ভবনের সামনে যে বটগাছ, তার নিচে শাহানা একান্তে বসেছিল। বিধ্বস্ত চেহারা, ফ্যাকাশে মুখ, বিধ্বস্ত চুল, স্খলিত বেশবাস—যেন ভূত দেখছি আমি।

বিস্ময়াপন্ন কণ্ঠে বলি, শাহানা তুমি! এখানে, এভাবে?

 উত্তরে মৃদু হাসল ও। হেসে বলল, কোন ভাবে দেখতে চেয়েছিলে, অনি? অনি, আমি আর বাঁচতে চাই না।

 মানে! এসব কী বলছ তুমি, শাহানা? কী হয়েছে একটু খুলে বলবে! আমি ওর দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকাই। আমার চারদিকে দুনিয়াসুদ্ধ দুলতে থাকে।

 কিছুক্ষণ চুপ। শাহানা তারপর বলল, ক্যাম্পাসে একটু আগে গোলাগুলি হচ্ছিল। ক্রসফায়ারে ও মরল না কেন! বিলিভ মি, ও মরলেই আমি বেঁচে যেতাম।

 ওর কথা শুনে আমি তড়িতাহত বোধ করি। কে! কে মরবে, শাহানা?

 জায়েদ। একটা জানোয়ার। শাহানা বলল। সত্যি বলতে, ওর দুচোখে এমন নিরেট ঘৃণা আমি আর কখনো দেখিনি।

 বুঝতে পারি, কেউ একজন তাকে ঠকিয়েছে। প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে তারপর পালিয়ে গেছে। কাপুরুষ একটা! মেয়েদের মন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে ওরা কী প্রমাণ করতে চায়! বীরপুঙ্গব!

 শাহানার চোখে জল। অথচ তাকে আমি সান্ত্বনা দিতে পারিনি। সব কষ্টের মলম বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না। শুধু এটুকু বলি, দেখ শাহানা, নিজেকে সামলে নে। সময়ের পলি পড়ে দেখবি একসময় সব ঠিক হয়ে যাবে। জাস্ট একটু সময়ের ব্যাপার।

 শাহানা কী বুঝল কে জানে। সে আলতো করে মাথা নাড়ল। শীতের রাতে তেঁতুলপাতায় যেমন করে শিশির জমে।

 শাহানা কিন্তু আমার কথা শোনেনি। সময়কেও অবকাশ দেয়নি ওর কষ্ট মুছে দেওয়ার। পরদিন সকালে শুনি নীল শাড়ি শাহানা আর নেই। রোকেয়া হলের চারতলা ভবনের ছাদ থেকে সে ঝাঁপ দিয়েছে। ও মারা গেছে।

সরকারি কর্মকর্তা, ঢাকা।