শুভ্রকে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল

>
শামীমা রীতা
শামীমা রীতা
জীবনের অনেক ঘটনাই রোমাঞ্চকর উপন্যাসকেও হার মানায়। আবার জীবনযাপনের কিছু ঘটনা ছুঁয়ে যায় হৃদয়, স্মৃতিতে গেঁথে থাকে আজীবন। বাস্তবের রুদ্ধশ্বাস কাহিনি ও জীবন যেমন বিভাগে ছুটির দিনে প্রতি সপ্তাহেই পাঠকের এ ধরনের লেখা তুলে ধরে। ৪ নভেম্বর প্রথম আলোর ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ছুটির দিনের এ দুটি বিভাগে পাঠকের বিশেষ লেখা আহ্বান করা হয়েছিল। তাতে সাড়া দিয়ে প্রচুর লেখা পাঠিয়েছেন পাঠকেরা। সেসব থেকে বাছাই করা লেখা নিয়ে সাজানো হয়েছে এবারের ছুটির দিনে।

ঘটনাটি ২০১৭ সালের। ঈদুল আজহার ছুটি শেষে অফিসে গেলাম। অফিসে গিয়ে জানতে পারলাম বন্ধু শাহরিয়ার শুভ্র নিখোঁজ, ফোনও বন্ধ। খবরটা শুনে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম, ‘ও আবার নিখোঁজ হয় কীভাবে! কোথায় লুকিয়ে আছে...’।

কিন্তু চারদিকে বেশ হইচই পড়ে গেছে। কয়েকজনের কাছে শুনলাম ও এমনটা কখনো করে না। এদিকে আরেক বন্ধু বাইরে থেকে এসে ‘নিখোঁজ সংবাদ’ লিখতে বসেছে। ওর কাছ থেকে শুনলাম থানায়ও নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে।

প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসছে। সময়ের সঙ্গে তাকে না পাওয়ার ঘটনা ভয়ানক কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে। আমি ডেস্কে বসে একটা সংবাদ লেখা শেষ করলাম। এমন সময় খবর এল নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার ভুঁইগড়ে এক অজ্ঞাতপরিচয় যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। নিহত যুবকের পরনে ফুলপ্যান্ট আর সাদা–কালো চেক শার্ট। গলায় একটা কাপড় রয়েছে। পুলিশের ধারণা, কে বা কারা শ্বাসরোধে হত্যা করে ডোবায় ফেলে গেছে।

পাশেই শুভ্রর নিখোঁজের সংবাদটা লেখা চলছে। সরকারি তোলারাম কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র শাহরিয়ার শুভ্র নিখোঁজ...। এক সহকর্মীর কাছ থেকে শুনলাম ভোরে বাসা থেকে বের হয় সে। সকালে একবার ফোনও তুলেছিল। কিন্তু কোনো কথা হয়নি। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, হাসপাতাল, মর্গেও খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। কোনো খোঁজখবর নেই।

পরদিন সকাল ১০টায় এক বন্ধুর ফোন পেয়ে ঘুম ভাঙল। এই খবরে যে শুভ্রকে পাওয়া গেছে...। শুনে কেমন দমবন্ধ হয়ে আসছিল। কোনো রকম গোসল সেরে বের হয়ে পড়লাম। ফতুল্লা থানার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। দুপুর ১২টা বাজে। হঠাৎ পাশ থেকে পিয়াল বলে উঠল, ‘দেখ, রীতা শুভ্র’। সবাই চমকে উঠলাম। থানার সামনে দাঁড়িয়ে একটা ছেলে ডিম কিনছে, যার পেছন দিকটা অবিকল শুভ্রর মতো।

অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম

হ্যাঁ, শুভ্রকে পাওয়া গেছে। ওই অজ্ঞাতপরিচয় যুবকের মৃতদেহটি শুভ্রর। মৃতদেহের ময়নাতদন্ত শেষ হয়েছে। আইনানুগ প্রক্রিয়া চলছে গ্রহণের। আমরা সবাই থানার বাইরে অপেক্ষা করছি। মৃতদেহের হাতের কাটা দাগ, পরনের চেক শার্ট আর ওর কাঁধের সুরমা রঙের ব্যাগটা দেখে নাকি ওর বাবা-মা, বন্ধুরা চিহ্নিত করেছে। এটাই শুভ্র।

ক্যামেরা ফ্ল্যাশ, আহাজারি, উৎসুক জনতার ভিড় ঠেলে আমরা শুভ্রকে নিয়ে চললাম ওর বাড়ির দিকে।

গত ১০ সেপ্টেম্বর শুভ্রর হত্যার দুই বছর হলো। ছিনতাইকারীরা একটি মুঠোফোনের জন্য হত্যা করে শুভ্রকে। পরদিন ডোবা থেকে অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে ওর লাশ উদ্ধার করা হয়। আসামিদেরও গ্রেপ্তার করা হয়। মামলা এখনো বিচারাধীন। দিনটি আজও ঘোরের মধ্যে ফেলে দেয়। চোখ বুজলেই প্রতিটি মুহূর্ত দেখতে পাই। মনে পড়লেই হাত-পা শিউরে ওঠে। অথচ ওই ছুটির আগেও ওর সঙ্গে কথা হয়েছিল। কাঁধে হাত রেখে বলেছিল ‘বিদায় বন্ধু’। 

মাঝেমধ্যে মনে হয় কোনো একদিন এসে পেছন থেকে মাথায় টোকা দিয়ে দুপাটি দাঁত বের করে বলবে ‘মজা করছিলাম, সরি দোস্ত।’

সাংবাদিক, নারায়ণগঞ্জ।