তীহানের বেঁচে ফেরা

>
তীহানের মা কানিজ ফাতেমা
তীহানের মা কানিজ ফাতেমা
জীবনের অনেক ঘটনাই রোমাঞ্চকর উপন্যাসকেও হার মানায়। আবার জীবনযাপনের কিছু ঘটনা ছুঁয়ে যায় হৃদয়, স্মৃতিতে গেঁথে থাকে আজীবন। বাস্তবের রুদ্ধশ্বাস কাহিনি ও জীবন যেমন বিভাগে ছুটির দিনে প্রতি সপ্তাহেই পাঠকের এ ধরনের লেখা তুলে ধরে। ৪ নভেম্বর প্রথম আলোর ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ছুটির দিনের এ দুটি বিভাগে পাঠকের বিশেষ লেখা আহ্বান করা হয়েছিল। তাতে সাড়া দিয়ে প্রচুর লেখা পাঠিয়েছেন পাঠকেরা। সেসব থেকে বাছাই করা লেখা নিয়ে সাজানো হয়েছে এবারের ছুটির দিনে।

২৫ জুন ২০১৭, রোববার। ঈদের আগের দিন। তীহানের বাবা তার মাকে একা রেখে ঈদ করতে চলে গেছে কুষ্টিয়ায়। তীহানের তখনো জন্ম হয়নি। ও মায়ের পেটে। ঢাকার বাসায় শুধু রিফা, মা আর মায়ের ভেতরে তীহান।

রাত পেরিয়ে ঈদের দিন সকাল। এমন ঈদের সকাল মা কখনো আগে দেখেনি। কখনো তো এ রকম একা ঈদ করতে হয়নি তাকে! আগের রাতে তৈরি করা খাবার মা আর রিফা খেয়ে নেয়। সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে থাকলে আয়নার দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে তীহানের মা। একি, মায়ের চোখ পুরো হলুদ। তার মানে জন্ডিস। মা কোথায় যেন পড়েছিল, গর্ভাবস্থার এই সময়ে এমন রোগ হলে মা ও শিশুর মৃত্যুঝুঁকি ৫০ ভাগ বেড়ে যায়। এখন কী করবে সে?

তাড়াতাড়ি ফোন দেয় তীহানের বাবাকে। তীহানের বাবার পরামর্শে মা ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ঈদের দিন। সব বন্ধ। অজানা আশঙ্কায় মা, রিফা এক ঘরে রাত কাটায়। রাতে তার ডাক্তার বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। মা বোঝে, একটা ভয়ংকর পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সে আর তীহান। পরদিন মা রিফাকে সঙ্গে নিয়ে টেস্ট করতে দেয়। বিকেল হলে টেস্টের রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করতে যায়। ডাক্তার রিপোর্ট খুব খারাপ বলে। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি হতে বলে। এর মধ্যে তীহানের নানু ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে পেরে ঢাকা রওনা হয়ে যায়। এদিকে তীহানের বাবাও রাতের শেষ বাসে ঢাকা আসবে বলেছে।

তীহানের নানুকে সঙ্গে নিয়ে মা যায় আরও কিছু টেস্ট করাতে। হাসপাতালে গিয়ে অপেক্ষা করতে করতে মা খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ে। খুব তেষ্টা পায়। অপেক্ষা করা ছাড়া কিছুই করার নেই।

২৯ জুন বিকেলে তীহানের মা হাসপাতালে ভর্তি হয়। ডাক্তারের স্যালাইন দেওয়ার কথা আটটার দিকে। কিন্তু হঠাৎ করেই পেটে তীব্র ব্যথা অনুভব করে মা। আজব ব্যথা। সহ্য করা যায় না। এমন ব্যথা জীবনে কখনো অনুভব করেনি মা। ডাক্তারকে জানানো হলে তিনি বলেন, পরদিন এসে ডেলিভারি করিয়ে দেবেন! তীহানের মা হিসাব করে গর্ভাবস্থায় তীহানের বয়স তখন ২৯ সপ্তাহ ১ দিন। সাধারণত ৩২ সপ্তাহ পূর্ণ হলে একটা শিশু পরিপূর্ণভাবে জন্মগ্রহণ করে। কখন কী হবে? রাতটা কীভাবে পার করে জানে তীহান আর তার মা। মা তাকে বলেছিল কষ্ট করে রাতটা পার করতে। সকাল হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। বিকেল চারটায় ডাক্তার আসে। সন্ধ্যা ৬টা ৪২ মিনিটে তীহান মায়ের বুকে আসে।   মাত্র কয়েক মুহূর্ত। এরপর তাকে  নিকুতে নিয়ে যায়। মা আর তীহান আলাদা থাকে। মা সারা রাত ঘুমোতে পারে না।

নানীর কোলে ছোট তীহান
নানীর কোলে ছোট তীহান

পরদিন ১ জুলাই ২০১৭। মা দেখে তীহানকে খুব ছোট্ট পাখির ছানার মতো একটি শিশু। মা ভালো করে তাকিয়ে থাকে। আজব, সে মায়ের চেহারার কিছুই পায়নি। এক দিন যায়, দুই দিন যায়; হাসপাতাল থেকে তীহানকে ছেড়ে দেয় না। চার দিনের দিন তীহানের রক্তে একটি জীবাণু পাওয়া গেল। এরপরের সাত দিন ডাক্তাররা শুধু অ্যান্টিবায়োটিক বদলাতে লাগল। কোনো কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। একপর্যায়ে তীহানের মাও আশা ছেড়ে দিল। ছাড়ল না শুধু দুজন, তীহানের বাবা আর তার নানা। শেষ অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়ে  গিয়েছিল। আশ্চর্যভাবে তীহান টিকে রইল পৃথিবীর বুকে। আরও সাত দিন পর ডাক্তাররা তীহানকে তার মায়ের কোলে তুলে দিল। ২২ দিন পর শীর্ণ তীহান তার মায়ের সঙ্গে বাসায় ফিরল। এরপর আরও ছয় মাস তীহান আর মা নানা রকম ঝড়-ঝাপটা সামলেছে। আজ যখন দৌড়াতে দৌড়াতে তীহান মাকে ‘মা, মা’ বলে জড়িয়ে ধরে, মা তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। কত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাচ্ছে ছেলেটা!

গবেষক, আদাবর, ঢাকা।