সেই রিকশাচালককে আজও খুঁজে ফিরি

>
পিয়াস মজিদ
পিয়াস মজিদ
জীবনের অনেক ঘটনাই রোমাঞ্চকর উপন্যাসকেও হার মানায়। আবার জীবনযাপনের কিছু ঘটনা ছুঁয়ে যায় হৃদয়, স্মৃতিতে গেঁথে থাকে আজীবন। বাস্তবের রুদ্ধশ্বাস কাহিনি ও জীবন যেমন বিভাগে ছুটির দিনে প্রতি সপ্তাহেই পাঠকের এ ধরনের লেখা তুলে ধরে। ৪ নভেম্বর প্রথম আলোর ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ছুটির দিনের এ দুটি বিভাগে পাঠকের বিশেষ লেখা আহ্বান করা হয়েছিল। তাতে সাড়া দিয়ে প্রচুর লেখা পাঠিয়েছেন পাঠকেরা। সেসব থেকে বাছাই করা লেখা নিয়ে সাজানো হয়েছে এবারের ছুটির দিনে।

কুমিল্লা শহরের মোগলটুলির মোবারক বেকারি আজও আছে, হয়তো নেই সে বেকারির সুস্বাদু মুড়ি–বিস্কুট। মুড়ির চেয়ে কিছুটা বড় আকৃতির মজার সেই বিস্কুট জিবে জল আনছে আজকের এই স্মৃতিচারণায়ও। বেকারির অনতিদূরে ছিল আমাদের বাসা। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে আমাদের ছোটবেলায় যখনই পকেটে দু-চার টাকার সমাগম হতো, তখনই ছুটতাম মুড়ি–বিস্কুট কেনার উদ্দেশ্যে। এমনই এক দুপুর। আমাদের বাসা তখন অতিথি-ভরপুর। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে খালাতো ভাই রাসেল, রনি, রিয়ান এসেছে। সবাই খেলছি। হঠাৎ বোন রুপা পাঁচটি টাকা আমার হাতে দিয়ে বলল,            ‘সবার জন্য মুড়ি–বিস্কুট নিয়ে আয়।’ পাঁচ টাকা তখন আমাদের কাছে অনেক। ‘পাঁচ টাকাতে অনেক মুড়ি–বিস্কুট মিলবে’ এটা ভাবতেই মন ভরে উঠল অজানা পুলকে। তৎক্ষণাৎ দে–ছুট মোবারক বেকারি। মুড়ি–বিস্কুট নেওয়া তো হলো, ওদিকে দুপুরের সূর্যটা গনগনে তাপ ছড়াচ্ছে মাথার ঠিক মাঝখানে। হঠাৎ কী হলো, এক অলীক দিক্‌ভ্রান্তিতে আমি বেমালুম ভুলে গেলাম বাসায় ফেরার রাস্তা। বুঝতে পারছি কাছেই বাসা। কিন্তু কোনোমতেই ঠাহর করতে পারছি না কোন দিক দিয়ে যাব। সুনসান জনবিরল দুপুরের রাস্তায় একলা একা আমার চোখ জলভারাতুর হয়ে উঠেছে বাসা আর আসন্ন স্বজন হারানোর আশঙ্কায়।

হঠাৎ দেখি খালি একটা রিকশা আমার সামনে দিয়ে যেতে যেতে আবার ফিরে আসছে আমারই দিকে। রিকশাওয়ালা বাহন থামিয়ে চাইছেন আমারই পানে। মাঝবয়সী সেই মানুষ বড় মমতার সঙ্গে জানতে চাইলেন, ‘কী হইছে বাবু তোমার? বাসা হারাই ফেলছ?’ আমি মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিলাম। ততক্ষণে প্রতি রাতে আম্মুর কাছে শোনা ছেলেধরার সব গল্প মাথায় কিলবিল করছে। শতভাগ সন্দেহ হলো, এই লোকটা ছেলেধরা না হয়ে যায় না, নয়তো কেন শুধু শুধু জানতে চাইবে আমার বাসা হারানোর গল্প!

আমি তাই মিথ্যে করে বললাম, ‘না কিছুই হারাইনি আমি’। রিকশাওয়ালা এ কথা শুনে আবারও তাঁর বাহন নিয়ে সামনে যেতে যেতে একটু পিছিয়ে বললেন, ‘আমি কিন্তুক ছেলেধরা না। তুমি উঠো রিকশায়, কোথায় বাসা বলো, পৌঁছায় দিই।’

আশ্চর্য! লোকটা আমার মনের কথা জানল কী করে? আমি ততক্ষণে বাসা খুঁজে পাওয়ার সব সম্ভাবনা হারিয়ে যেন একটু ভরসা করতে শুরু করলাম রিকশাচালকের ওপর। কিন্তু আম্মুর কাছে এ–ও শিক্ষা পেয়েছি যে কারও কাছ থেকে বিনা পয়সায় কোনো কিছু গ্রহণ করতে নেই। বিস্কুট কেনার পর আমার কাছে তো কোনো টাকা নেই। তাঁকে বললাম, ‘আমার বাসা মোগলটুলি শাহসুজা মসজিদের কাছে। কিন্তু আমার কাছে ভাড়া দেওয়ার মতো কোনো টাকা নেই এখন।’ শুনে বললেন, ‘আগে ওঠো বাবু। বাসা খুঁজে বের করো, ভাড়ার বিষয় পরে দেখা যাবে নে।’ এর মধ্যে রিকশাচালকের কাছে অন্য যাত্রীও আসছিল অনেক কিন্তু তিনি তাদের কাউকে বাহনে না তুলে ছোট্ট আমাকে রিকশায় তুলে একটু মোড় ঘুরতেই দিগ্‌ভ্রান্তি কাটিয়ে আমি চিনে ফেললাম আমাদের প্রিয় বাসা।

হঠাৎ আমার খেয়াল হলো, বাসায় আমার মাটির ব্যাংকে জমানো কিছু টাকা তো আছে। সেখান থেকে টাকা নিয়ে রিকশাচালককে দেওয়া যাবে (বাসায় আমার হারানোর গল্প বলে রিকশাভাড়া চাইলে নিশ্চয় আম্মুর কাছে বকা শুনতে হবে, তাঁকে না বলে বাসার বাইরে যাওয়ায়)। আমি রাস্তার মোড়ে রিকশা থামিয়ে চালককে বললাম, ‘আপনি একটু দাঁড়ান, আমি আপনার ভাড়াটা নিয়ে আসছি।’ আমি বাড়িতে ঢুকে মুড়ি–বিস্কুটের প্যাকেট ভাইবোনদের হাতে দিয়ে পাগলের মতো মাটির ব্যাংক থেকে তিন-চার টাকা বের করে রাস্তায় এসে দেখি ভাড়া না নিয়েই সেই রিকশাচালক চলে গেছেন ততক্ষণে, মিলিয়ে গেছেন দূর অজানায়।

আমার তখন অনুশোচনায় দগ্ধ হওয়ার পালা। ভদ্রলোক শ্রেণির আমরা এমন শ্রমজীবী মানুষকে যেভাবে সন্দেহ করে থাকি সব সময়, ঠিক একই ভাবনায় আমি প্রথম থেকেই তাঁকে ছেলেধরা বলে সন্দেহ করেছি। অথচ তিনি আমাকে ঠিকমতো বাসায় পৌঁছে দিয়ে তাঁর প্রাপ্য ভাড়া না নিয়েই চলে গেলেন। তাঁকে আমি ভাড়া তো দিতে পারলামই না, পারলাম না ধন্যবাদ দিতেও।

আজও আমি হাজার রিকশার ভিড়ে সেই অসাধারণ রিকশাচালককে খুঁজি। যদি সত্যিই খুঁজে পেতাম তবে বলতাম, ‘আপনি একটি ছোট্ট ছেলেকে তার হারানো বাড়ি খুঁজে পেতে নিজে যেচে সহায়তা করলেন। আর আজ আমরা কোনোমতেই খুঁজে পাচ্ছি না এমন বিশুদ্ধ বিশ্বাস কিংবা নিঃস্বার্থ ভালোবাসার বাড়ি। নিয়ে যাবেন আমাকে সেই হারানো বাড়ির দিকে?’

কবি, ঢাকা।