২০ এপ্রিল রাতের বিভীষিকা

>
তাহসান রহমান খান
তাহসান রহমান খান
জীবনের অনেক ঘটনাই রোমাঞ্চকর উপন্যাসকেও হার মানায়। আবার জীবনযাপনের কিছু ঘটনা ছুঁয়ে যায় হৃদয়, স্মৃতিতে গেঁথে থাকে আজীবন। বাস্তবের রুদ্ধশ্বাস কাহিনি ও জীবন যেমন বিভাগে ছুটির দিনে প্রতি সপ্তাহেই পাঠকের এ ধরনের লেখা তুলে ধরে। ৪ নভেম্বর প্রথম আলোর ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ছুটির দিনের এ দুটি বিভাগে পাঠকের বিশেষ লেখা আহ্বান করা হয়েছিল। তাতে সাড়া দিয়ে প্রচুর লেখা পাঠিয়েছেন পাঠকেরা। সেসব থেকে বাছাই করা লেখা নিয়ে সাজানো হয়েছে এবারের ছুটির দিনে।

আমি তখন ব্ল্যাক ব্যান্ডের সদস্য। আমাদের প্রথম দুই অ্যালবাম আমার পৃথিবী আর উৎসবের পর তখন প্রকাশ পেয়েছে। শহুরে কিশোর-কিশোরীরা ব্ল্যাকের গানের প্রেমে বুঁদ হয়ে আছে। এমন একটি সময়ে আমরা গিয়েছিলাম চট্টগ্রামে।

দিনটি ছিল ২০০৪ সালের ২০ এপ্রিল। জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা সেই সময় চট্টগ্রামে কনসার্ট শেষ করে ঢাকায় ফিরছিলাম আমি, জন (জন কবির), জাহান (মুশফিক জাহান), টনি (মেহমুদ টনি) আর মিরাজ। সঙ্গে আছেন মবিন ভাই (ইমরান আহমেদ চৌধুরী), যিনি তাঁর কাজের মাধ্যমে এ দেশে গানের ইতিহাসের পাতায় আজও শ্রেষ্ঠত্বের শিখরে বসে আছেন। ব্ল্যাক কিছুদিন হলো কনসার্টে মবিন ভাইয়ের সাউন্ড ডিজাইনের সুযোগটা পেয়েছে। আমাদের আইডলরা যাঁকে সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে না বসিয়ে মঞ্চে উঠতে চাইতেন না, সেই মবিন ভাই আমাদের জন্য সাউন্ড ঠিক করতে বসেন। আর সঙ্গে ছিল তানিম—আরবোভাইরাস ব্যান্ডের তখনকার ড্রামার আর আমাদের একনিষ্ঠ ভক্ত।

টনি ছিল আমাদের কনসার্টের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে। তাই আমাদের যাতায়াতের মাইক্রোবাস ওরই ঠিক করা। মাইক্রোবাসের প্রথম সারিতে চালকের পাশে মিরাজ, মাঝখানের সারিতে জন, আমি আর জাহান। পেছনে মবিন ভাই, টনি আর তানিম। তখন ভোররাত পৌনে চারটা। আমরা কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম পার হয়েছি। মাইক্রোবাস চলছিল তার সাধারণ গতিতে। যাত্রা শুরুর দিকের আড্ডা গল্পের প্রহর শেষ করে সবাই ঘুমে আচ্ছন্ন। আচমকা বিকট এক শব্দে ঘোর কাটতেই দেখি, আমাদের মাইক্রোবাস এক দিকে হেলে পুরো উল্টে গেল।

এরপর ঘূর্ণিপাকে একে একে পাঁচ–ছয়বার ঘুরে মহাসড়কের ঠিক মাঝখানে উল্টে নিথর পড়ে থাকা। আমি, জাহান, জন আর টনি অনেক চেষ্টা করে জানালার কাচ গলে বেরিয়ে পড়ি।  চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমরা চারজনই উদ্‌ভ্রান্তের মতো চিৎকার করছি। এরই মধ্যে মহাসড়ক ধরে দূরে একটা বাস আসছে বলে মনে হলো। সেই বাসের আলো যখন কিছুটা কাছে চলে এল, তখন দেখতে পাচ্ছিলাম রাস্তায় পড়ে থাকা তিনজনের নিথর দেহ। তাঁরা—মবিন ভাই, মিরাজ আর আমাদের গাড়ির চালক। তানিম তখনো মাইক্রোবাসের ভেতরে।

একে একে কয়েকটি বাস এল। ভোররাত চারটায় ছুটে চলা সেই বাসগুলোকে থামানোর জন্য আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করে গেলাম। চেষ্টা করলাম, যে করে হোক বাসে তুলে ওদের কাছের হাসপাতালে নিতেই হবে। কিন্তু একটি বাসও থামতে চাইল না। অনেক চেষ্টার পর একটা বাস থামানো গেল।

মিরাজ, মবিন ভাই আর চালককে আমরা সেই বাসে তুলে নিলাম। কিছুদূর যেতে না–যেতেই বাস থেকে আমাদের নামিয়ে দিয়ে বলা হলো, সামনেই হাসপাতাল। রাস্তায় নেমে বুঝতে পারি, আমরা তখনো হাসপাতাল থেকে অনেকটা দূরে। ঠিক তখনই আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।

সেই সময়ের ব্ল্যাক—(বাঁ থেকে) টনি, জাহান, তাহসান, জন ও মিরাজ। ছবি: সংগৃহীত
সেই সময়ের ব্ল্যাক—(বাঁ থেকে) টনি, জাহান, তাহসান, জন ও মিরাজ। ছবি: সংগৃহীত

যখন জ্ঞান ফিরে পেলাম, তখন বুঝতে পারছিলাম না কোথায় এবং কী অবস্থায় আছি। তখনো চারদিকে অন্ধকার। শুধু বুঝতে পারলাম, আমার কোলে মিরাজের নিথর দেহ, আর পড়ে আছি মহাসড়কের পাশে। কিন্তু বাকিরা গেল কোথায়? বাকিদের কারও কোনো সাড়াশব্দ নেই কেন? ভাবতে ভাবতে চিৎকার করে ডাকতে থাকি। কেউ যদি শুনতে পায়। হঠাৎ দূর থেকে এক রিকশাচালক আমার চিৎকার শুনে কাছে এলেন। রিকশাচালক আর আমি মিরাজকে ধরাধরি করে রিকশায় তুলে হাসপাতালের দিকে রওনা দিলাম। মিরাজের জ্ঞান তখনো ফেরেনি। তাকে কোলে নিয়ে সেই রিকশা এগোতে থাকল। পথটুকু আমার জীবনের সবচেয়ে বিভীষিকাময় পথ মনে হতে থাকল। রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত মিরাজ সংজ্ঞাহীন, তার অবশ শরীরটায় প্রাণ যেন আঁকড়ে থাকে—আল্লাহকে ডাকতে ডাকতে সেই একটাই প্রার্থনা করে চললাম।

ইমরান আহমেদ চৌধুরী।
ইমরান আহমেদ চৌধুরী।

হাসপাতালে পৌঁছাতেই ভোর হলো। মিরাজকে স্ট্রেচারে শুইয়ে রেখে বাঁ পাশে তাকাতেই দেখি, মবিন ভাই। প্রাণহীন মবিন ভাই। সেই প্রাণহীন মুখের কথা আমি লিখব না। মবিন ভাই আমার চোখে হাস্যোজ্জ্বল এক অসাধারণ মানুষ হয়ে বেঁচে আছেন। থাকবেন যত দিন না আবার দেখা হয় পরের অধ্যায়ে।

ততক্ষণে বুঝতে পারলাম, বাকিরা সবাই বেঁচে আছে। কিন্তু মবিন ভাইয়ের মরদেহ আর দুমড়েমুচড়ে যাওয়া অর্ধমৃত মিরাজকে দেখে দম বন্ধ হওয়া এক অনুভূতি। কাঁদতে কাঁদতে যখন হাসপাতালের বাইরে এসে দাঁড়ালাম, তখন সূর্য উঠছে। মাটিতে বসে পড়লাম তীব্র ব্যথায়। অঝোরে বমি করলাম। আমার মুখের ঠিক সামনে দুটি সারমেয়, সেগুলো লেহনে ব্যস্ত। এত করুণ, এত জঘন্য, এত বিয়োগান্তক রাতের কথা আমি আজও ভুলতে পারি না। চাই না, কারও জীবনে এমন রাত আসুক।

আমরা ব্ল্যাক সেই রাতের ক্ষত কাটিয়ে উঠতে পারিনি। মিরাজের সেই ভেঙে যাওয়া হাড়গুলোর মতো আমরাও ভেঙেচুরে ছড়িয়ে চৌচির হয়ে গিয়েছিলাম। অনেক দিনের সংগ্রামের পর ও উঠে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ব্ল্যাক সংগ্রামটা করতে পারেনি। ২০ এপ্রিলের পরের দিনগুলো অভিমানের। সেই কথাগুলো কখনো বলিনি, হয়তো মৃত্যুর আগে কখনো একদিন আমরা আবার একসঙ্গে দাঁড়াব...সেই দিন সব অভিমান ভুলে যাব।

সংগীতশিল্পী ও অভিনেতা