যে চিঠির কথা হয়নি বলা

অংলকরণ: মাসুক হেলাল
অংলকরণ: মাসুক হেলাল

আমি তখন কলেজে পড়ি। গ্রাম থেকে সবে শহরে এসেছি। শহুরে বিকেল খুব বিষণ্নতায় কাটত। একা একদিন বিকেলে ছাদে বসে বই পড়ছিলাম। হঠাৎ পাশের বাসার বারান্দায় তাকাতেই দেখি এক নারী। বয়স ৩০ কি ৩৫ হবে। সুশ্রী সেই নারী আক্রমণ করেছিল আমার হৃদয়। প্রতিদিন তাঁকে দেখতে ছাদে যেতাম। আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড় এক নারীকে এভাবে ভালো লেগে যাবে, কল্পনাও করতে পারিনি।

একদিন লোডশেডিংয়ের দীর্ঘ সন্ধ্যায় আমি তাঁকে দেখতে অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম, একটি চিঠি লিখে তাঁর বারান্দায় ছুড়ে ফেলে দেব। মনের কথা জানাব। আমি তাঁকে এটাও জানাব, তাঁকে বারান্দায় না দেখলে আমার কেন একা একা লাগে সারা সন্ধ্যাবেলা।

এমন সময় আমার কাঁধে হাত রেখে একজন বললেন, খামের চিঠিটা পৌঁছে দিতে হবে সেই নারীর বাসার নিচতলার ফটকে। বকশিশ ২০ টাকা। চোখ ফেরাতেই দেখি পাশের গলির বড় ভাই। বুকের ভেতর আচমকা মোচড় দিয়ে উঠল। না, এ হতে পারে না।

কিন্তু তখন কিছুই করার ছিল না। নিজের হৃদয়ের অনটনের কথা ভুলে গিয়ে হেমন্তের পাতাঝরা অরণ্যের ডাকপিয়ন সেজে আমি সেদিন চিঠি পৌঁছে দিয়েছিলাম। আমার চাকরি হয়ে গেল ‘ডাকপিয়ন’ পদে। আরেক দিন সন্ধ্যায় সে বড় ভাই চিঠি দিয়ে বললেন, পরদিন সকালে সেই নারীর বাসার নিচতলায় পৌঁছে দিতে হবে। নড়বড়ে মন নিয়ে আকাশ-পাতাল ভেবে আমি সেই চিঠি খুলে ফেললাম। খামের ভেতর থেকে খসে পড়ছে একেকটি তাজা গোলাপের পাপড়ি।

কী ভেবে মনে হলো সেই চিঠির জায়গায় আমি চিঠি পাঠাব। আমার মনের কথা জানাব। সারা রাত জেগে চিঠি লেখা শুরু করলাম। আমার অঙ্ক খাতা ভরে গেল মনের সব অজানা কথায়। ভয়ে ভয়ে চিঠি পৌঁছে দিলাম। কিন্তু পরদিন উত্তর আনতে গিয়ে তেমন কিছু চোখে পড়েনি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। চিঠি নেওয়ার দৃশ্য দেখে মৃদু হেসেছিলেন। তাঁর হাসি দেখে আমার হৃদয়ে কম্পন সৃষ্টি হয়েছিল। নিজেকে কোনো রকম সামলে চিঠি নিয়ে ঢুকে পড়লাম পাশের মুদি দোকানে। এ-কী? এ তো আমার লেখা চিঠির জবাব। আমার ভালোবাসার কথাগুলোর বিপরীত শব্দে লেখা। অদ্ভুত এক খুশিতে আমার দিন-রাত কাটল।

মনে মনে স্থির করলাম পরীক্ষা শেষে তাঁকে জানাব আসলে মূল চিঠি লেখক আমি। শুধু চিঠির তলায় থাকত বড় ভাইয়ের নাম।

পরীক্ষার চাপে কিছুদিন খোঁজ করতে পারিনি। সে সময়ের মাঝেই হঠাৎ একদিন হারিয়ে গেলেন সেই নারী। বড় ভাইয়ের সে ভালোবাসার পর্বও স্থায়ী হয়নি বেশি দিন। ভাড়াটে বাড়ির মতো প্রেমও ঠিকানা বদলে চলে গেছে তাঁর সদ্য বিদেশফেরত স্বামীর কাছে।

তাঁকে আমার কোনো দিন বলাই হয়নি, সেই ছায়াচিঠির লেখক আসলে আমি। শূন্য বারান্দার সেই বাড়ির পাশ দিয়ে গেলে কেবল মন খারাপ হতো ভীষণ। রাত জেগে চিঠি না লিখতে পারার যন্ত্রণাটা এখনো খুব জ্বালাতন করে আমাকে।

পরিসংখ্যান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।