ভালোবাসা ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে

ফুটবল খেলেও কিছুটা সময় কেটেছে
ফুটবল খেলেও কিছুটা সময় কেটেছে

ছুটির দিন সকাল। ঢাকার রাস্তায় তখনো যানজট জেঁকে বসেনি। ফাঁকা পথ ধরে গাড়ি ছুটছে নারায়ণগঞ্জের দিকে, গন্তব্য নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলা। সেখানে হচ্ছে ব্যতিক্রমী আয়োজন ‘প্রজন্ম মেলা’।

রাজধানীর হাতিরঝিল থেকে রওনা হয়ে ৩০০ ফুট সড়ক দিয়ে কাঞ্চন ব্রিজ, সেখান থেকে ডানে মোড়, আরও খানিকটা পথ গিয়ে মিলল ‘আফনানের দাদাবাড়ি’ রিসোর্ট। এখানেই ‘অটুট থাকুক প্রজন্মের অনুভূতি’ স্লোগান নিয়ে আয়োজিত ‘প্রজন্ম মেলা’।

মূল ফটক দিয়ে রিসোর্টের ভেতর দিকে একটু এগিয়ে যেতে চোখে পড়ল রঙিন শামিয়ানা। শামিয়ানার এক পাশে বিশাল মঞ্চ, অন্য পাশে সারি সারি চেয়ার। শিশু-কিশোর বয়সী একদল বাচ্চার হইহুল্লোড়ে মুখর চারপাশ। মাঠের এপাশ-ওপাশজুড়ে খেলছে একদল উজ্জ্বল ছেলেমেয়ে। শামিয়ানার নিচে বসে আছেন ৬০ পেরোনো একদল মানুষ। চুপ করে বসে নেই তাঁরা, মেতে আছেন গল্পে। মঞ্চের পাশে বিশাল শব্দ–সরঞ্জামে বেছে চলছে গান। শামিয়ানার এক পাশে বসেছে চিপস, বিস্কুট আর ডাবের দোকান। অন্য পাশে বড় ডেকচিতে চলছে রান্না। খাবারের সুঘ্রাণ চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে।

সব মিলিয়ে দারুণ একটা পরিবেশ। ঠিক যেন মেলা। উচ্ছল একদল মানুষ যেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তবে অন্য আট-দশটি মেলার চেয়ে অনেকভাবেই আলাদা এই আয়োজন। এই মেলায় এসেছেন একদল সুবিধাবঞ্চিত বৃদ্ধ এবং শিশু। এই বৃদ্ধরা থাকেন বৃদ্ধাশ্রমে। শিশু-কিশোরদের কেউ থাকে এতিমখানায়, বাকিরা খোলা আকাশের নিচে, অর্থাৎ পথশিশু। দুই প্রজন্মের বয়সের ব্যবধান অনেক। কিন্তু একটা দুঃখ দুই দলেরই সমান। প্রিয়জনের সঙ্গে যোগাযোগ নেই, বা প্রিয়জন কাছে নেই, একাকী জীবন কাটছে। সবাই বঞ্চিত আদর-ভালোবাসা থেকে, নিজের একান্ত অনুভূতি প্রকাশের সুযোগ থেকে। এমন দুই প্রজন্মের দুই দলকে নিয়েই ১৮ অক্টোবর ছিল ‘প্রজন্ম মেলা’।

অনুষ্ঠান শুরু হয় সবাই মিলে জাতীয় সংগীত গেয়ে। সারা দিনের এই আয়োজনে এরপর ছিল গল্প বলার আসর। যেখানে মেলায় সদ্য পাওয়া দাদা-দাদির কাছে গল্প শোনে নাতি-নাতনিরা। এরপর শুরু ছেলে ও মেয়েদের ক্রিকেট-ফুটবল। অন্যদিকে ছিল দড়ি লাফসহ নানা খেলাধুলা। দেখলাম, নাতি-নাতনিদের সঙ্গে দাদিরাও ব্যাট হাতে নেমে গেছেন উইকেটের সামনে। এই শিশু-কিশোরদের প্রতিভার যে কমতি নেই, সেটা বোঝা গেল চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায়। দারুণ সব ছবি এঁকেছে তারা। সাংস্কৃতিক পর্বে সুন্দর সুন্দর ছড়া, গান ও নাচ পরিবেশন করে মুগ্ধ করেছে সবাইকে।

ভিন্নধর্মী এই মেলার উদ্যোক্তা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটির নাম ‘সোশ্যাল চেইন ফর ডেভেলপমেন্ট’। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মো. আমিনুল ইসলাম বললেন, ‘প্রজন্ম মেলাটি একটি প্রতীকী আয়োজন। যেখানে একদল বয়ষ্ক মানুষ  এবং শিশু-কিশোর অংশগ্রহণ করছে। মেলায় বয়ষ্করা যেন খুঁজে পাবেন তাঁদের নাতি-নাতনিদের আর শিশু-কিশোরেরা খুঁজে পায় দাদা-দাদিদের। অনুভূতিশীল এই প্রজন্ম দুটির অনুভূতি প্রকাশের সুযোগ করে দেওয়াই এই আয়োজনের উদ্দেশ্য। আমরা সমাজে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে বন্ধন সৃষ্টি করতে চাই। যেন একজন বৃদ্ধ বা শিশুকে একাকী জীবন অতিবাহিত না করতে হয়।’

দুপুর গড়িয়ে তখন বিকেল ছুঁই-ছুঁই। শরতের বিকেল, তারপর আবার গ্রামের পরিবেশ, আকাশে সাদা মেঘ উড়ে যাচ্ছে, শুরু হয়েছে সন্ধ্যার আগে ঘরে ফিরতে থাকা পাখির কিচিরমিচির। তখন আমরা ঢাকার পথে। আর দশটি বিকেলের সঙ্গে এই বিকেলের পার্থক্য অনেক। যে বিকেলে দেখছি কতগুলো মানুষের চোখে-মুখে খুশির ঝিলিক। এমন করে যদি প্রতিদিন, প্রতিটা বিকেল এই মানুষগুলো, এই মানুষগুলোর মতো সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা আরও হাজার হাজার মানুষের চোখে-মুখে খুশির ঝিলিক ছড়িয়ে দেওয়া যেত। আহা, কী দারুণ হতো!