মোহাম্মাদ আলীর শখের নৌকা

খালপাড়েই নবীন এক বটগাছ। নিজের হাতে রোপণ করা সেই গাছের সঙ্গেই নৌকাটি বেঁধে রেখেছেন মোহাম্মাদ আলী শেখ। কালো পলিথিন সরিয়ে নৌকায় উঠে পড়েন তিনি। মোহাম্মাদ আলী শেখ নৌকায় পা রেখেই এই প্রতিবেদককে জানালেন যাত্রী হওয়ার আহ্বান। পাটাতনে পা রেখেই নজর কাড়ল নৌকার গায়ে রং-তুলিতে আনাড়ি হাতে লেখা কিছু শব্দ। যেখানে লেখা, ‘শখের নৌকা, পরিচালনায়: মোহাম্মাদ আলী শেখ, নালুয়া বাজার, চিতলমারী, বাগেরহাট’।

মোহাম্মাদ আলীর নৌকা দেখতে আর দশটা নৌকার মতোই। ব্যতিক্রম নৌকার শেষ অংশ। সেখানে বসানো পুরোনো মোটরসাইকেল আর দুই পাশে বিশেষ প্রপেলার বা পাখা। পাখা দুটো তৈরি করা হয়েছে ভ্যানগাড়ির চাকা দিয়ে।

অভিনব নৌকা নিয়ে ছুটেছেন মোহাম্মাদ আলী। ছবি: লেখক
অভিনব নৌকা নিয়ে ছুটেছেন মোহাম্মাদ আলী। ছবি: লেখক

মোহাম্মাদ আলী গিয়ে বসলেন মোটরসাইকেলের আসনে। চালু করতেই সচল হলো ইঞ্জিন। গিয়ার ফেলতেই ঘুরতে শুরু করল দুই পাশের পাখা। পানিতে আলোড়ন। ধীরে ধীরে পানি কেটে চলতে শুরু করে শখের নৌকাটি। সরু খালে কচুরিপানার ফাঁক গলে মোটরবাইকের শব্দ তুলে এগিয়ে যায় নৌকা। পাড় থেকে কৌতূহলী অনেক তাকিয়ে দেখেন। পরিচিত শব্দ শুনে অনেক শিশু ছুটে আসে বাড়ির পেছনে, দেখে মোহাম্মাদ আলীর অভিনব নৌকা। এভাবে খালে দুই চক্কর দিয়ে ফিরে আসি পাড়ে। নৌকায় বসে কথা শুরু করি মোহাম্মাদ আলীর সঙ্গে।

তাঁর বয়স ৩৩ বছর। ৯ ভাইবোনের মধ্যে অষ্টম মোহাম্মাদ আলী। বাবার রেখে যাওয়া কিছু ফসলি জমি আর নালুয়া বাজারের একটি দোকানঘর তাঁর সম্বল। খেয়ালি মানুষ হিসেবে এলাকায় পরিচিতি আছে তাঁর। বিয়ে–থা করেননি। জানালেন, দোকানটা তাঁর ফাঁকা পড়ে আছে। শিগগিরই কোনো একটা ব্যবসা শুরু করবেন।

শখের নৌকা নিয়ে মোহাম্মাদ আলী বলেন, ‘ছোটবেলায় মুরব্বিদের মুখে গাজী রকেট নামের লঞ্চের কথা শুনেছি। কাঠের বড় বড় পাখা ঘুরত সেই লঞ্চের দুই পাশে। সে সময় থেকেই ভাবতাম, আমার যদি এমন একটা লঞ্চ থাকত! সেটা তো আর সম্ভব হয়নি, তাই সেই শখ কিছুটা পূরণ করতেই এই নৌকা বানিয়েছি।’

মোটরবাইকেই চলে নৌকা
মোটরবাইকেই চলে নৌকা

নৌকাটি বানাতে নিজের মোটরসাইকেল বেছে নিয়েছিলেন মোহাম্মাদ আলী। নৌকাটি ছয় হাজার টাকায় কিনেছেন স্থানীয় একজনের কাছ থেকে। কারিগরি বিষয়ে সহায়তা নিয়েছেন নালুয়া বাজারের সাতজন কারিগরের। শুধু কারিগর নন, ব্যতিক্রমী এই নৌকা তৈরি করতে দেখে এলাকার অনেকেই বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেছেন। দিয়েছেন পরামর্শও। ‘এ জন্য আমার শখের নৌকার প্রতি এলাকার মানুষের আলাদা মায়া আছে।’

মায়া আছে বলে মোহাম্মাদ আলীও নৌকাতে ঘোরার সুযোগ দেন এলাকাবাসীকে। ইচ্ছেমতো ঘুরলেও জ্বালানি খরচ নেন না কারও কাছ থেকে। তবে শিশুদের নৌকায় তুলতে বেশ কঠোর তিনি। স্কুলের সময়ে একদমই শখের নৌকার কাছে ঘেঁষতে দেন না। 

শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক খালটি কাটিয়েছিলেন বলে খালটির পরিচিত ‘হক ক্যানেল’ নামে। শান্ত খালে ডিঙি নৌকা ছাড়া তেমন নৌযান চলে না। তাই খালের দুই পাড়ের শিশুদের কাছে শখের নৌকার আছড়ে পড়া ঢেউ অবাক করে।

প্রতিনিয়ত এমন দৃশ্য অনুপ্রাণিত করে মোহাম্মাদ আলীকে। নৌকাটি বটগাছে বাঁধতে বাঁধতে জানালেন, ‘আমার শখের নৌকাটি আরও উন্নত করতে চাই।’