জাদুঘরে টাইটানিক-আখ্যান

জাদুঘরে টাইটানিক জাহাজের একটি খুদে প্রতিকৃতি। ছবি: সংগৃহীত
জাদুঘরে টাইটানিক জাহাজের একটি খুদে প্রতিকৃতি। ছবি: সংগৃহীত

১৯১২ সালের ১৪ এপ্রিল টাইটানিক জাহাজ ডোবার ঘটনা সারা বিশ্বকে আলোড়িত করেছিল। বইপত্রে সে ঘটনা পড়লেও আমাদের প্রজন্মকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছিল ১৯৯৭ সালে মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্র টাইটানিক। সেই সময়ের সবচেয়ে ব্যয়বহুল বাজেটে নির্মিত এবং সর্বাধিক ১১টি বিভাগে অস্কার পুরস্কার পায় টাইটানিক। জ্যাক ও রোজের চরিত্রে লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও ও কেট উইন্সলেটের প্রাণবন্ত অভিনয় এবং তাঁদের মর্মান্তিক বিচ্ছেদ জাহাজডুবিকেও ছাপিয়ে গিয়ে কোটি কোটি দর্শককে অশ্রুসিক্ত করেছিল।

গত জুলাই মাসে ইংল্যান্ড সফরের সুযোগ হয়। এক সপ্তাহের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ছিল সাউদাম্পটন শহরে। তখনো জানতাম না এখানে টাইটানিকের স্মৃতিবাহী জাদুঘর গড়ে উঠেছে। ইংল্যান্ডপ্রবাসী বান্ধবী অদিতি এ খবর প্রথম আমাকে দেয়। আমি উত্তেজনায় ছটফট করতে থাকি সেখানে যাওয়ার জন্য। সাউদাম্পটনে পৌঁছার পর এক বিকেলে বেরিয়ে পড়ি এই জাদুঘরের উদ্দেশে। সহকর্মী তানবীর, জিলুফা, নাসির, নুসরাতের মধ্যেও অন্তহীন আগ্রহ টাইটানিক জাদুঘরকে ঘিরে। যদিও টাইটানিক জাদুঘরের আনুষ্ঠানিক নাম ‘সি সিটি মিউজিয়াম’।

যেভাবে কয়লা ব্যবহার হতো টাইটানিকে।
যেভাবে কয়লা ব্যবহার হতো টাইটানিকে।

১৯১২ সালের এপ্রিল মাস। পরীক্ষামূলক চালুর পর টাইটানিক নামের প্রমোদতরি প্রথম বাণিজ্যিক যাত্রার জন্য তৈরি। জাহাজের স্বত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠান হোয়াইট স্টার লাইন ঘোষণা করে, তাদের জাহাজটি কোনো দিন ডুববে না। ১৯১২ সালের ১০ এপ্রিল দুপুরে যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটন থেকে শুরু হলো পশ্চিমমুখী যাত্রা। আটলান্টিক মহাসাগরের বুক চিরে টাইটানিকের গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক। ১১ এপ্রিল পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন পোতাশ্রয় থেকে যাত্রী তোলা হলো। এরপর অবিরাম সাগরে ছুটে চলা। কিন্তু তিন দিন পরই ঘটল দুর্ঘটনা।

ক্রুদের সম্পর্কেও জানা গেল জাদুঘরে।
ক্রুদের সম্পর্কেও জানা গেল জাদুঘরে।

১৪ এপ্রিল মধ্যরাত। আটলান্টিক মহাসাগরে ভাসতে থাকা একটি হিমশৈলের সঙ্গে সজোরে ধাক্কা লাগে আরএমএস (রয়্যাল মেইল স্টিমার) টাইটানিকের। ২ ঘণ্টা ৪০ মিনিট পর রাত ২টা ২০ মিনিটে (তখন ১৫ এপ্রিল) প্রযুক্তির উৎকর্ষ ও অহংকার নিয়ে টাইটানিক আটলান্টিকে তলিয়ে গেল। ঘটে গেল বিংশ শতকের ভয়ংকরতম সামুদ্রিক ট্র্যাজেডি। সেই ঘটনায় টাইটানিকের ১ হাজার ৫১৭ জন শীতার্ত যাত্রী ও ক্রু ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড উষ্ণতার সমুদ্রজলে অসহায় অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।

ইংরেজি টাইটানিক শব্দের বাংলা অর্থ দানবীয়। আইরিশ প্রকৌশলী উইলিয়াম পিরির নকশায় তৈরি জাহাজটি প্রকৃত অর্থেই ছিল দানবাকৃতির। টাইটানিক দৈর্ঘ্যে ছিল ৮৮৩ ফুট, প্রস্থে ছিল ৯২.৫ ফুট। নিচের দিকের মূল কাঠামো ছিল ১৬টি অংশে বিভক্ত। তখন দাবি করা হয়েছিল, জাহাজটির প্রতিটি কাঠামো পানির জন্য দুর্ভেদ্য এবং অন্তত চারটি কুঠুরি ভেঙে পানি ঢুকে গেলেও জাহাজটি ডুববে না। তাই যাত্রীরা নির্দ্বিধায় বেছে নিয়েছিলেন জাহাজটিকে পছন্দের বাহন হিসেবে।

সি সিটি মিউজিয়ামের ভেতরে হতভাগ্য যাত্রী ও ক্রুদের নাম, পরিচয় ও ছবি যেকোনো দর্শককে স্তম্ভিত করে দেবে। একটি গৌরবজনক ইতিহাসের অংশী হতে তাঁরা চড়েছিলেন টাইটানিকে। কে জানত স্বপ্নযাত্রার চার দিন পরেই সলিলসমাধির কারণে তাঁরা ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেবেন।

জাদুঘরের প্রথম কামরায় শোভা পাচ্ছে ক্যাপ্টেন স্মিথসহ ছয়জন ক্রুর ছবি। প্রত্যেকেই হোয়াইট স্টার লাইনের দক্ষ কর্মী ছিলেন। টাইটানিকে মোট ৮৯৭ জন ক্রু ছিলেন, যার তিন-চতুর্থাংশই ছিলেন সাউদাম্পটনের অধিবাসী। জাহাজটি সমুদ্রে চলাচলের উপযোগী কি না, তা এক বছর ধরে পরীক্ষা করা হয়। ১৯১১ সালের মে মাস থেকে ১৯৯২ সালের এপ্রিল—এই সময়সীমার মধ্যে বেলফাস্ট থেকে সাউদাম্পটনে পৌঁছায় টাইটানিক। ১৯১২ সালের ১০ এপ্রিল বিশ্বের ইতিহাসের সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী জাহাজ সাউদাম্পটন ত্যাগ করে নিউইয়র্কের উদ্দেশে ২ হাজার ২৩৪ জন যাত্রীকে সঙ্গে নিয়ে।

অত্যন্ত বিলাসবহুল প্রস্তুতি নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল টাইটানিক। ছয় হাজার টন কয়লার মজুত ছিল জাহাজে। সপ্তাহব্যাপী এই প্রমোদভ্রমণকে যাত্রীদের জন্য আরামপ্রদ করে তুলতে কর্তৃপক্ষের চেষ্টার কমতি ছিল না। পুষ্টিকর খাবার, পানি, মদ, শয্যা, ফুল, সিগারেট কোনো কিছুর ঘাটতি ছিল না। সাউদাম্পটনের ব্যবসায়ীরা শহরের সবচেয়ে টাটকা পণ্য সরবরাহ করেছিলেন জাহাজে। একদম শেষ মুহূর্তে তাঁরা ডিম ও ফুল সরবরাহ করেন।

টাইটানিকের সঙ্গে জড়িত ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ সামগ্রী দিয়ে ভরে তোলা হয়েছে জাদুঘর। ক্যাপ্টেন স্মিথের ককপিট, তলোয়ার, ঘড়ি, শিকল, ব্যবহৃত কয়লা ও আলিশান পার্টি সেন্টার সযত্নে রক্ষিত জাদুঘরে। বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে কর্তৃপক্ষ টিকিট বিক্রি করেছিল। সবচেয়ে বিলাসবহুল স্যুইটের মূল্য ছিল ৮৭৫ পাউন্ড। এরপর প্রথম দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির টিকিট ছিল নানা মূল্যে। দুর্ঘটনার পর সবার আগে ডুবে যায় তৃতীয় শ্রেণির বগি। এই বগির সবাই প্রাণ হারান। ১৪ এপ্রিল রাতে দুর্ঘটনা ঘটার পরবর্তী ২ ঘণ্টা ৪০ মিনিটে সমুদ্রের ১৩ হাজার ফুট নিচে তলিয়ে যায় জাহাজটি। নারী ও শিশুদের অগ্রাধিকার দিয়ে জাহাজ থেকে লাইফবোট ছাড়া হয়েছিল। এমন একটি বোটে ছিলেন দুই মাস বয়সী মিলভিনা ডিন। সর্বশেষ জীবিত ডিন ২০০৯ সালে ৯৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

সাউদাম্পটনের সি সিটি মিউজিয়াম পরিচিতি পেয়েছে টাইটানিক জাদুঘর হিসেবে।
সাউদাম্পটনের সি সিটি মিউজিয়াম পরিচিতি পেয়েছে টাইটানিক জাদুঘর হিসেবে।

টাইটানিক জাদুঘরে এই মর্মান্তিক ঘটনাকে জীবন্ত করে তুলেছে সেই সময়ের সংবাদপত্র ও টেলিফোনে ধারণকৃত দুঃসংবাদের ধারাবিবরণী। বাটন টিপে টেলিফোনের রিসিভার কানে ধরলেই শোনা যায় সেই হৃদয়বিদারক মুহূর্তের খবর। যতক্ষণ শুনছিলাম, আমার শরীরে কাঁটা দিচ্ছিল। ১৯১২ সালের এপ্রিল মাসের সংবাদপত্রে নিহত যাত্রীদের ছবিসংবলিত সংবাদপত্র যেকোনো দর্শককে নাড়া দেবে।

টাইটানিক জাদুঘরের অন্যতম আকর্ষণ ‘দ্য ইনকোয়ারি’ কক্ষ। বিশাল এই কক্ষে পিনপতন নীরবতা, চারপাশে অন্ধকার। সামনে খোলা জায়গা। দুই পাশে দুই জায়ান্ট স্ক্রিন। এই স্ক্রিনে দেখানো হচ্ছে এই দুর্ঘটনার নাটকীয় তদন্তের দৃশ্য। ১৯১২ সালের ১২ মে লন্ডনে তদন্ত কমিশন গঠিত হয়। ৩৭টি গণশুনানি হয়। ক্রু, যাত্রী, বিশেষজ্ঞ মিলে ৯৭ জন সাক্ষ্য দেন। অত্যন্ত দ্রুত গতিতে চলমান এই কমিশনের প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখে ৩০ জুলাই।

প্রতিবেদনে বলা হয়, অতিরিক্ত গতিতে ধাবমান টাইটানিকের সঙ্গে প্রচণ্ড হিমশৈলের সংঘর্ষই দুর্ঘটনার কারণ। জাহাজের নকশায় কোনো ত্রুটি খুঁজে পাওয়া যায়নি। পর্যাপ্তসংখ্যক লাইফবোট না থাকায় জাহাজ কর্তৃপক্ষকে দায়ী করা হয়। জায়ান্ট স্ক্রিনে পাঁচটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত। প্রখ্যাত অভিনয়শিল্পীরা এতে অংশগ্রহণ করেন। তদন্তপ্রক্রিয়ার ওপর ভিত্তি করে এর চিত্রনাট্য রচিত।

টাইটানিক ট্র্যাজেডি থেকে শিক্ষা নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ১৯১৪ সালে আটলান্টিকঘেঁষা ১৩টি দেশের প্রতিনিধিরা লন্ডনে সভা করে সমুদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিক চুক্তি প্রণয়ন করেন। নিঃসন্দেহে এটি আগের তুলনায় সমুদ্রে জাহাজ চলাচলকে আরও নিরাপদ করেছে। অধিকতর সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কারণে বর্তমানে সমুদ্রে বড় ধরনের দুর্ঘটনার হার নেই বললেই চলে। এমন নিরাপদ সমুদ্রযাত্রা নিশ্চিত করার জন্য টাইটানিক ট্র্যাজেডিতে নিহত যাত্রীদের কাছে মানবসভ্যতা ঋণী।