পড়ি, নিজেকে গড়ি

মডেল: সাদ ও সিফাত। ছবি: খালেদ সরকার
মডেল: সাদ ও সিফাত। ছবি: খালেদ সরকার
>সময়োপযোগী দক্ষতা রপ্ত করা, পেশাগত সক্ষমতার উন্নয়ন কিংবা নিজেকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণাদায়ী ও পরামর্শমূলক এমন অনেক বই আছে, যেগুলো সারা বিশ্বেই জনপ্রিয়। তরুণেরা সেসব বই পড়ছেন, আলোচনা করছেন। ভবিষ্যতের প্রস্তুতি নিতে হলে এসব বই পড়া কি জরুরি?

হঠাৎ একটা সোনার খনির সন্ধান পেলে মানুষের কেমন অনুভূতি হতে পারে, সেটা প্রথম উপলব্ধি করি ২০১২ সালে।

ছোটবেলায় বই পড়ার অভ্যাস তৈরি হয়েছিল খুব অদ্ভুতভাবে। ক্লাস সেভেনে চন্দ্রনাথ স্যার নামে একজন শিক্ষকের কাছে পড়তাম। তাঁকে দেখে পাণ্ডিত্যের ওপর খুব আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বই স্যার এনে দিয়েছেন। আগ্রহ নিয়ে পড়েছি। পরে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ মুজতবা আলী থেকে শুরু করে তিন গোয়েন্দা, মাসুদ রানাও গিলেছি গোগ্রাসে। অনুপ্রেরণামূলক, শিক্ষণীয় বা আত্মোন্নয়ন (সেলফ ডেভেলপমেন্ট) সংশ্লিষ্ট নন-ফিকশন পড়ার প্রতি কখনো তেমন আগ্রহ হয়নি। একে তো হাতের কাছে পাইনি, প্রয়োজনও বোধ করিনি।

২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট আমাকেসহ বাংলাদেশের ১০ জন উদ্যোক্তাকে নিয়ে গেল একটা এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে। ওখানে আমি ডিজিটাল টিউটরস ডট কম নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পিউশ প্যাটেল আমাকে একটা বই উপহার দিলেন, নাম ফাইভ ডিসফাংশনস অব আ টিম। লেখক প্যাট্রিক লেনচিওনি।

প্রথমেই মনে হলো, এসব বই তো আমি পড়ি না। সাজিয়ে রেখে দেওয়া ছাড়া এই বই নিশ্চয়ই খুব একটা কাজে আসবে না। একদিন কৌতূহল থেকে দু-এক পাতা ওলটালাম। একসময় বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করলাম, পুরো বইটাই আমি পড়ে ফেলেছি। তত দিনে উদ্যোক্তা জীবনের ১২ বছর পার করেছি। আমার প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন সাত শর বেশি মানুষ। এই বই পড়তে গিয়ে ভীষণ ভালো লাগল, কারণ দেখলাম এখানে সেই সব সাধারণ চ্যালেঞ্জের কথাই লেখা আছে, আমি প্রতিদিন যেগুলোর মুখোমুখি হই। আগে ভাবতাম, এসব নিয়ে আবার পড়ার কী আছে? এগুলো তো এমনিই সমাধান করা যায়। কিন্তু একটি বই আমার ভাবনার জগতে বড় পরিবর্তন এনে দিল। একের পর এক নন–ফিকশন পড়তে শুরু করলাম। মনে হলো, আমি কোনো সোনার খনির সন্ধান পেয়েছি।

কেন পড়ব

বই পড়ার সঙ্গে কি সফলতার কোনো সম্পর্ক আছে? আছে নিশ্চয়ই। আশপাশে যত সফল মানুষ দেখি, তাঁদের অধিকাংশই খুব ভালো পাঠক। মার্কিন উদ্যোক্তা ওয়ারেন বাফেট প্রতিদিন অন্তত ৫০০ পৃষ্ঠা পড়েন। বিল গেটস শুধু পড়েনই না, তাঁর পড়া বইগুলো নিয়ে নিজের ব্লগে লেখেন। ইলন মাস্ক নাকি হাইস্কুলে পড়ার সময়ই এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা পুরোটা পড়ে শেষ করে ফেলেছিলেন!

অন্য দিকে একই সঙ্গে এমন অনেক মানুষও তো আছেন, যাঁরা প্রচুর বই পড়েন, কিন্তু সফল নন। তাহলে?

অনেক পাঠক শুধুই আনন্দের জন্য পড়েন। মনের খোরাক জোগাতে নিঃসন্দেহে বই একটা চমৎকার উপায়। বই পড়ার সময় অনেকের প্রাথমিক লক্ষ্য থাকে স্রেফ মজা পাওয়া, সঙ্গে যদি কিছু শেখা যায়, তবে সেটা বোনাস। কিন্তু আপনি যদি প্রতিদিন নিজেকে একটু উন্নত করতে চান, নিজের মধ্যে পরিবর্তন আনতে চান, আরও বেশি কর্মক্ষম হতে চান, তাহলে শেখাটাই হতে হবে প্রথম লক্ষ্য। শিখতে গিয়ে আমি হয়তো সব সময় মজা পাব না। কোনো কোনো বই হয়তো খুবই ক্লান্তিকর, কিন্তু বইটা থেকে শেখার আছে। তাহলে সেই বই আমার পড়তে হবে।

আমরা জানি সৃজনশীল পরীক্ষায় চারটি ধাপ থাকে। জ্ঞানমূলক, অনুধাবনমূলক, প্রয়োগ ও উচ্চতর দক্ষতা। বই পড়াও কার্যকর হতে পারে এই চার ধাপে। বেশির ভাগ মানুষ প্রথম দুই ধাপে আটকে থাকেন। যেমন আমি যদি বারবার একটা বই পড়ে মুখস্থ করে ফেলি, তবু সেটা কোনো কাজে আসবে না, যদি আমি না বুঝি। আবার আমি বুঝলাম, কিন্তু প্রয়োগ করতে পারলাম না, তাতেও আসলে কোনো লাভ নেই। যদি পড়ে, বুঝে, প্রয়োগ করে, আমি আমার প্রাপ্ত জ্ঞান কাজে লাগিয়ে নতুন জ্ঞান তৈরি করতে পারি, তাহলেই আমি সফল।

আমার লক্ষ্য কী, কিংবা কোন ক্ষেত্রে ক্যারিয়ার গড়তে চাই, এসব বিবেচনা করে বই বেছে নিতে হবে
আমার লক্ষ্য কী, কিংবা কোন ক্ষেত্রে ক্যারিয়ার গড়তে চাই, এসব বিবেচনা করে বই বেছে নিতে হবে

কীভাবে পড়ব

২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত আমি তৃষ্ণার্তের মতো নন-ফিকশন পড়েছি। বাছ-বিচার নেই। হাতের কাছে যা পেয়েছি, তা-ই পড়েছি। মুশকিল হলো, শেখাটা কোথাও কাজে লাগাতে পারিনি। দেখা গেল বিক্রয় বা সেলসের একটা বই পড়ে দারুণ অনুপ্রাণিত হলাম। পরদিনই আবার মাইন্ডসেটসংক্রান্ত একটা বইয়ে বুঁদ হয়ে গেলাম। লক্ষ করে দেখলাম, এই বিচ্ছিন্নভাবে পড়া আসলে আমার কোনো কাজে আসছে না। কারণ, আমি আমার শেখাটা কোথাও প্রয়োগ করতে পারছি না।

২০১৬ সাল থেকে তাই পদ্ধতি বদলেছি। প্রতিবছরের শুরুতে আমি একটা নির্দিষ্ট বিষয় ঠিক করি। বছরজুড়ে ওই বিষয়সংক্রান্ত সেরা বইগুলো পড়ে ফেলি। অন্য বই পড়ি না তা না। কিন্তু আমার লক্ষ্য বা ফোকাস একদিকেই থাকে। যেমন ধরুন, ২০১৬ সালে ঠিক করলাম আমি বিক্রয় বা সেলস নিয়ে পড়ব। আমার ধারণা ছিল, এ বিষয়ে আমার জ্ঞান মোটামুটি ভালো। ১০০–তে মোটামুটি ৭০ তো পাবই। নিজের জ্ঞান আরেকটু ঝালিয়ে নিতে এক বছর ধরে আমি সেলস সংক্রান্ত প্রায় ১৬-১৭টা বই পড়লাম।

পড়া শেষে বুঝলাম, ১০০–তে আমি বড়জোর টেনেটুনে ৩০ পেতে পারি! কত কী জানার আছে, শেখার আছে! যেমন ধরুন, আমার ধারণা ছিল যাঁরা ভালো কথা বলতে পারেন, ‘সেলস পারসন’ হিসেবে তাঁরাই সবচেয়ে ভালো। ফ্র্যাংক ব্রেটজারের হাউ আই রেইজড মাইসেলফ ফ্রম ফেইলিওর টু সাকসেস ইন সেলিং পড়ে জানলাম, বিক্রয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ‘বলা’ নয়, ‘শোনা’; এবং বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে প্রশ্ন করা। বইটা লেখা হয়েছে সেই ১৯৪০–এর দশকে। আমি পড়েছি ২০১৬ সালে। অথচ বিষয়গুলো কী আশ্চর্য প্রাসঙ্গিক!

অতএব অগোছালোভাবে পড়লে হবে না। ‘ফোকাস’ ঠিক রেখে পড়তে হবে। এমন অনেক নন-ফিকশন বই আছে, যেগুলোর ভাষা খুব সরল, গল্পের ছলে লেখা। শুরু করার জন্য এই বইগুলো ভালো। ইংরেজি পড়তে অসুবিধা হলে বাংলা অনুবাদ পড়তে পারেন। বাংলাদেশি লেখকদেরও অনুপ্রেরণামূলক বা আত্মোন্নয়নসংক্রান্ত বই আছে। যেমন মুনির হাসানের গ্রোথ হ্যাকিং মার্কেটিং, ঝংকার মাহবুবের রিচার্জ ইওর ডাউন ব্যাটারি, আয়মান সাদিকের নেভার স্টপ লার্নিং...

 ‘শেখার জন্য পড়া’ শুরুর আরেকটা ভালো উপায় হলো আত্মজীবনী পাঠ। যে ব্যক্তির প্রতি আপনার আগ্রহ আছে, হতে পারেন তিনি নেলসন ম্যান্ডেলা, শচীন টেন্ডুলকার, কিংবা স্টিভ জবস, তাঁদের আত্মজীবনী পড়ে দেখতে পারেন। নিশ্চয়ই নিজের জীবনে চর্চা করার মতো কিছু না কিছু পাবেন।

পছন্দের বিষয় অনুযায়ী আত্মোন্নয়নমূলক নন–ফিকশন পড়ার চর্চা গড়ে তুলতে পারেন। স্থান কৃতজ্ঞতা: বাতিঘর
পছন্দের বিষয় অনুযায়ী আত্মোন্নয়নমূলক নন–ফিকশন পড়ার চর্চা গড়ে তুলতে পারেন। স্থান কৃতজ্ঞতা: বাতিঘর

কী পড়ব?

এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আগে বুঝতে হবে, আমার কী প্রয়োজন? আমি কোথায় যেতে চাই? কোথায় আমার ঘাটতি? কেউ যদি বলেন আমি উদ্যোক্তা হতে চাই, তাঁর জন্য একরকম পাঠ। কেউ চাকরি করতে চান, তাঁর জন্য আরেক রকম পাঠ। কারও কিছুই ভালো লাগে না, কারও আবার সবই ভালো লাগে, দুজনের ওষুধ আলাদা। নিজের চাহিদা বা সমস্যা আগে ধরতে হবে।

কেউ যদি ভাবেন—আমি কিছু গুণ রপ্ত করতে চাই, পড়তে পারেন স্টিফেন কভের সেভেন হ্যাবিটস অব হাইলি ইফেক্টিভ পিপল, চার্লস ডুহিগের দ্য পাওয়ার অব হ্যাবিট, কিংবা হাল এলরডের দ্য মিরাকল মর্নিং: দ্য নট-সো-অবভিয়াস সিক্রেট গ্যারান্টিড টু ট্রান্সফর্ম ইওর লাইফ (বিফোর এইট এএম)। সফল হওয়ার ওপর কিছু ক্ল্যাসিক্যাল বই আছে। যেমন নেপলিয়ন হিলের থিংক অ্যান্ড গ্রো রিচ পড়তে পারেন।

যদি মনে হয় আপনি কী চান, কী চান না, কিছুই জানেন না; জীবনের লক্ষ্য এখনো ঠিক করতে পারেন; নিজের শক্তি কিংবা দুর্বলতার জায়গাগুলো এখনো আপনার কাছে অস্পষ্ট—সে ক্ষেত্রেও ওষুধ আছে! পড়তে পারেন ডু হোয়াট ইউ আর: ডিসকভার দ্য পারফেক্ট ক্যারিয়ার ফর ইউ থ্রো সিক্রেটস অব পার্সোনালিটি টাইপ। আমি মনে করি এই বইটা সবার পড়া উচিত।

বিষয়ভিত্তিক বই খুঁজে পাওয়া একদম সহজ। গুগলে সার্চ করুন। আমাজনে দু–একটা বইয়ের সমালোচনা পড়ুন। কী পড়তে হবে, আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন।

তবে সবার আগে গুরুত্বপূর্ণ হলো কিছু পেতে হলে কষ্ট করতে হবে, এই বোধ নিজের মধ্যে তৈরি করা। আমি যদি কিছু শিখতে চাই, আমাকে একটু হলেও পরিশ্রম করতে হবে। শুধুই আনন্দ পাওয়ার উদ্দেশ্যে পড়া নিজেকে আরও উন্নত করতে খুব একটা সাহায্য করবে বলে মনে হয় না।

লেখক: উদ্যোক্তা, অন্যরকম গ্রুপ