প্যাপিরাস থেকেই পেপার

মিসরের গোল্ডেন প্যাপিরাস কারখানায় তৈরি প্যাপিরাস কাগজ। ছবি: লেখক
মিসরের গোল্ডেন প্যাপিরাস কারখানায় তৈরি প্যাপিরাস কাগজ। ছবি: লেখক

নভেম্বর মাসেই মিসর ভ্রমণে গিয়েছিলাম। ঐতিহ্যের মিসরে নানা জায়গা ঘুরে একবার হাজির হয়েছিলাম কায়রোর গোল্ডেন প্যাপিরাস কারখানায়। প্যাপিরাস গাছ থেকে কীভাবে লেখার কাগজ তৈরি হয় তা–ই চর্মচক্ষে দেখার বসনা নিয়ে সেই কারখানায় যাওয়া। 

মিসর থেকে কেনা হানড্রেড ফ্যাক্টস অব অ্যানশিয়েন্ট ইজিপ্ট ও অল অ্যাবাউট ইজিপ্ট বই দুটো থেকে প্যাপিরাস সম্পর্কে অনেক কিছুই জেনেছি। জেনিছি, খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ সালে নীল নদের তীরে উৎপন্ন নলখাগড়াজাতীয় প্যাপিরাসগাছের বাকলকে মিসরীয়রা লেখার উপকরণ হিসেবে ব্যবহার শুরু করে। ধীরে ধীরে মিসরীয়রা প্যাপিরাসে ছবিও আঁকতে থাকে। সময়ের বিচারে মিসরীয় রাজ্য শাসনকালকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায়, পুরোনো রাজ্য (২৬৮৬-২১৬০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ), মধ্যবর্তী রাজ্য (২০৫৫-১৬৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) এবং নবরাজ্য (১৫৫০-১০৬৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)। নবরাজ্যের আমলে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল এই প্যাপিরাসের পাতায় চিত্র অঙ্কন। মূলত মৃতের সঙ্গে মৃত্যু-পরবর্তী জীবন সম্পর্কে ধারণা, নিয়মকানুনের বর্ণনা ও মৃতের নৈতিক চরিত্রের সুপারিশমূলক বর্ণনা লিপিবদ্ধ ও চিত্রিত, এমন অসংখ্য প্যাপিরাসের সন্ধান পান প্রত্নতত্ত্ববিদেরা। ফলে মিসরীয় চিত্রকলার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের মোড়ক উন্মোচিত হয়।

মনে করা হয়, বই তৈরির সংস্কৃতি প্যাপিরাসের দান। গ্রিসের মহাকবি হোমার তাঁর বিখ্যাত ইলিয়াড মহাকাব্যটি প্যাপিরাসের কাগজে লিখেছিলেন। যেটি প্যাপিরাসের ২৪টি রোলে সম্পন্ন করা হয়েছিল। মৃত ব্যক্তির চরিত্রসম্পর্কিত বর্ণনামূলক বই দ্য বুক অব ডেথ নামের অতি প্রাচীন গ্রন্থ (যা বেদের থেকেও প্রাচীন মনে করা হয়) প্যাপিরাসে লেখা হয়েছিল, যার এক কপি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে। তা ছাড়া বিখ্যাত আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির অনেক প্রকাশনা প্যাপিরাসে লেখা। আরও বড় কথা, ইংরেজি পেপার শব্দটি এসেছে প্যাপিরাস থেকেই।

তাই প্যাপিরাসগাছ থেকে কাগজ তৈরির প্রক্রিয়া দেখার আগ্রহটা ছিল প্রবল। কারখানায় দেখলাম, প্রথমে প্যাপিরাসগাছের ওপরের শক্ত সবুজ অংশটি কেটে ফেলা হয়। ভেতরের সাদা অংশটি কাগজ তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়। তারপর সেই সাদা অংশ পাতলা করে কেটে একটি সমান জায়গায় বিছিয়ে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে এর আঁশ ভেঙে ফেলা হয়। তারপর সেই পাতলা অংশ ছয় দিন পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। সাধারণত দুই রঙের প্যাপিরাস তৈরি হয়—সাদা আর বাদামি। সাদা রং পেতে ছয় দিন এবং বাদামি রং পেতে দুই সপ্তাহ ভিজিয়ে রাখতে হয়। পরবর্তী পর্যায়ে পানি থেকে তুলে একটি কাপড়ের ওপর লম্বালম্বি ও আড়াআড়ি বিছিয়ে অন্য একটি কাপড় দিয়ে ঢেকে একটি লোহার যন্ত্র দিয়ে চেপে রাখা হয়। দুই-তিন দিন রাখার পর বের করলে লম্বা ও আড়াআড়ি রেখে দেওয়া অংশগুলো জোড়া লেগে কাগজের মতো হয়ে যায়। প্রাচীনকালে চেপে রাখার যন্ত্রটি উদ্ভাবনের আগে মিসরীয়রা দুই পাথরের মাঝে রেখে দিত প্যাপিরাস।

প্যাপিরাস থেকে তৈরি এই বিশেষ ধরনের কাগজ খুব মজবুত হয় এবং এর স্থায়িত্বকাল তিন হাজার বছর পর্যন্ত হয়ে থাকে। আসল প্যাপিরাস কাগজ চিনতে হলে সেটিকে আলোর বিপরীতে ধরলে আড়াআড়ি ও লম্বালম্বি রেখাগুলো স্পষ্ট বোঝা যায় এবং প্যাপিরাস পানি নিষ্কাশন করে না।

তবে প্যাপিরাসের কাগজ তৈরির পদ্ধতি দেখার আগেই মিসরের বিভিন্ন শহরের মন্দিরে এবং সমাধিস্থলে পাথর কেটে দেয়াললিখন, দেয়ালচিত্র ও হায়ারোগ্লিফিকগুলো উপভোগ করেছি। এর ফলে প্যাপিরাসের কাগজ তৈরি আমার কাছে শতভাগ সহজ মনে হচ্ছিল।

লেখক: পর্যটক